নির্বাচনী জনসভায় শব্দবিধি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বিচারিতার অভিযোগ উঠল বীরভূমের পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নলহাটি শহরে তাদের প্রচারসভায় লাগানো মাইক পুলিশ জোর করে খুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করল বিজেপি। আর তার পর দিনই ঘন জনবসতিপূর্ণ নলহাটির একটি স্কুলের খোলা মাঠে ৩৫টি সাউন্ড বক্স বাজিয়ে সভা করে বিতর্কের মুখে পড়ল তৃণমূল। সভায় উপস্থিত দলের শীর্ষ নেতা মুকুল রায় এবং রাজ্যের দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও চন্দ্রনাথ সিংহ।
ঘটনা হল, রাজ্য পরিবেশ দফতরের সাম্প্রতিক নির্দেশিকা (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩) অনুযায়ী বোর্ড পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন দিন আগে থেকে শেষ দিন পর্যন্ত জনবসিতপূর্ণ এলাকা বা স্কুলচত্বর ও তার কাছাকাছি জায়গায় মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজিয়ে সভা করা যাবে না। এমনটা হলে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পুলিশ ও প্রশাসনেরই। সেই সরকারি নির্দেশিকাকে তুড়ি মেরে কী ভাবে রাজ্যেরই মন্ত্রীরা ওই সভা করলেন, তা নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। প্রশ্ন উঠেছে জেলা পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। |
দলীয় প্রার্থীর প্রচারে নলহাটির হরিপ্রসাদ হাইস্কুলের মাঠে বিকেল তিনটে নাগাদ শুরু হয় তৃণমূলের সভা। সভাস্থলের ১০০ মিটারের মধ্যেই হরিপ্রসাদ হাইস্কুলের স্কুল ভবন। ২০০-২৫০ মিটারের মধ্যেই একটি মাদ্রাসা পরীক্ষা কেন্দ্র। নেতাদের বক্তৃতার আগে ছোট-বড় ৩৫টি সাউন্ড বক্সে তারস্বরে বাজতে থাকে গান। চারটের দিকে মঞ্চে আসেন মুকুল রায়। সঙ্গে ফিরহাদ হাকিম। সভা চলে প্রায় সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত। স্কুল মাঠের দেওয়াল বরাবর নামকেওয়াস্তে বাঁশ খাটিয়ে কাপড় দিয়ে মাঠটিকে ঢাকার একটা অক্ষম চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের কর্মীরা। তাতে অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি।
নির্বিঘ্নে সভা মেটার পরে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, মুকুলবাবু দাবি করেন, “গত ৫ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ দফতর নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। তাতে কোথাও ‘ওপেন এয়ার’ কথাটি লেখা নেই। আমি ভুল প্রমাণিত হলে রাজনীতি করা ছেড়ে দেব!” পরিবেশ দফতরের আধিকারিকেরা কিন্তু বলছেন, নতুন নির্দেশিকায় ‘ওপেন এয়ার’-এর শর্তটি না থাকলেও সেখানে স্পষ্টই বলা আছে, এ সময় জনবসিতপূর্ণ এলাকা বা স্কুলচত্বর ও তার কাছাকাছি জায়গায় এ ধরনের সভা করা বেআইনি।
গোটা ঘটনা নিয়ে জেলা প্রশাসনের কিছু কর্তা জড়িয়েছেন পারস্পরিক কাজিয়ায়।
বীরভূমের পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “আইন ভেঙে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” সভা চলাকালীন পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি? তাঁর যুক্তি, “অনেক সময়ই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নিতে হয়।” রামপুরহাটের মহকুমাশাসক রত্নেশ্বর রায় জানান, বিষয়টি ‘মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট’ টিমকে দেখতে বলা হয়েছে। ওই টিমের নলহাটি থানা এলাকার ইন-চার্জ অনুপকুমার বসাকের বক্তব্য, “ওখানে যে ৩৫টি সাউন্ড বক্স চলছে, তা আমরা সংশ্লিষ্ট বিডিওকে জানিয়েছিলাম। বিডিও আমাকে বলেন, ওখানে মাইক বাজছে কি না দেখতে। তিনি আরও বলেন, মাইক না বাজলে, সাউন্ডবক্সগুলির আওয়াজ কমিয়ে দিতে।” তৃণমূল অবশ্য সেই অনুরোধ রাখেনি বলেই তাঁর দাবি। |
নলহাটি ১ ব্লকের সেই বিডিও (এই কেন্দ্রের সহকারী রিটার্নিং অফিসারও) তাপস বিশ্বাসের পাল্টা দাবি, “আমার সঙ্গে অনুপবাবুর কোনও কথাই হয়নি! এ বিষয়ে যা বলার রিটার্নিং অফিসারই বলবেন।” অনুপবাবুর পাল্টা, “বিডিও এখন নিজের কথা অস্বীকার করছেন।” সমস্ত ঘটনায় নলহাটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার সুব্রত রায়ের প্রতিক্রিয়া, “ওই সভায় মাইক বাজানোর অনুমতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছি। বেআইনি কাজ হলে নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশাসন দায় এড়িয়ে যেতে চাইলেও শাসকদলের ওই কাণ্ড নিয়ে একযোগে সরব হয়েছে বাম-কংগ্রেস-বিজেপি। নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের তরফে ইতিমধ্যেই অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নলহাটির কংগ্রেস প্রার্থী আব্দুর রহমান। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী দীপক চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “যাঁরা রাজ্য চালাচ্ছেন, তাঁরাই আইন ভাঙছেন! সাধারণ মানুষ তা হলে কার কাছে যাবেন?” বামফ্রন্ট পুরো বিষয়টি নিয়েই রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও জেলার নির্বাচন আধিকারিকের কাছে অভিযোগ জানাবে বলে তিনি জানিয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশ তৃণমূলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে! পুলিশ এসে আমাদের সভা বাতিল করে দিলেও তৃণমূলের সভা দিব্যি চলছে। রাজ্যের শাসকদল স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছে।”
বস্তুত, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নলহাটির ডাকবাংলা মাঠে মাইক বাজানোর জেরে তাদের সভা বাতিল হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নলহাটি থানার ওসির-র বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে বিজেপি। এ দিন সকালেই রামপুরহাটে একটি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে রাহুলবাবু বলেন, “প্রশাসনের প্রয়োজনীয় অনুমতি থাকার পরেও যে ভাবে আমাদের প্রচারের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, তা মেনে নেওয়া যায় না! আমরা নির্বাচন কমিশনারের কাছে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। তেমনই দলগত ভাবে নলহাটির ওসি-র বিরুদ্ধে আমরা আদালতে মামলা করতে চলেছি।”
নলহাটি থানার ওসি মহম্মদ আলি-র অবশ্য দাবি, “থানার দিকে মুখ করে মাইক লাগানো হয়েছিল। তাই আমি বিজেপি কর্মীদের বলি, মাইক বাজাবেন না। ওঁরাই মাইক খুলে নেন। পুলিশ খোলেনি।” |