গাড়িতে লাঠি, জানলায় আছড়ে পড়ছে রাগী মুখ |
যা খুশি হয়ে যেতে পারত যে কোনও মুহূর্তে।
এই ভয়টাই বুকে চেপে ধরছিল। দমবন্ধ করে বসেছিলাম উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের গাড়ির মাঝের আসনে। রাগী মুখগুলো দুই জানলায় আছড়ে পড়ছে আর শিউরে শিউরে উঠছি। এক দিকে লাঠির বাড়ির শব্দে আঁতকে উঠলে অন্য দিক থেকেও ভেসে আসছে দমাদ্দম আওয়াজ। বাইরের ঠাসা ভিড়ে তখন দেখা যাচ্ছে না সামনের পুলিশের গাড়িটিকেও। তারও আগে রয়েছে পাইলট কার। মন্ত্রীর গাড়ির পিছনে ছিল কনভয়ের আরও তিনটি গাড়ি। সেগুলিও ভিড়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তাই কিছু একটা বড় বিপদ হয়ে গেলে নিরাপত্তা রক্ষীরা থেকেও কিছু করতে পারবেন না। তাঁরা যে দরজা খুলে নামতেই পারবেন না। সামনের গাড়ি থেকেও কেউ এই ভিড় ঠেলে মন্ত্রীর গাড়ির সামনে আসতে আসতে বিপদ ঘটে যেতে পারে অনায়াসে। পাহাড়ের খাড়াই রাস্তা দিয়ে সাবধানে নামতে নামতে ওই ভিড় আচমকাই কালিম্পংয়ের আট মাইল এলাকায় ঘিরে ধরেছিল গাড়িটাকে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল গাড়ির গায়ে, ছাদে লাঠির বাড়ি। বেলা তখন এগারোটা বেজে এগারো। মাত্র কিছু ক্ষণ আগেই টাউন হলে লেপচারা গৌতমবাবুর উপস্থিতিতেই পাঁচ দিনের অনশন প্রত্যাহার করেছেন, কিছুটা খুশি মনেই তারপরে শিলিগুড়ির দিকে ফিরছিলেন তিনি।
গৌতমবাবু ছিলেন চালকের বাঁ দিকের আসনে। কাচ তোলা থাকলেও তাঁকে বোঝা যাচ্ছিল বাইরে থেকে। উইন্ডস্ক্রিনে দুমদাম পড়ছিল লাঠির বাড়ি। শোনা যাচ্ছিল ‘বিমল গুরুঙ্গ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছিল। মন্ত্রীকে ‘গো ব্যাক’-ও বলা হল। গৌতমবাবুর ঠিক পিছনের আসনে বাঁ দিকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে এক নিরাপত্তা রক্ষী। ডান দিকে মন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক অমিত দত্ত। তাঁদের দু’জনের মাঝখানে বসেছিলাম আমি। পিছনের লম্বা আসনে আরও এক জন নিরাপত্তা রক্ষী। তাঁরও হাতে একে ৪৭। ছিলেন জেলা তৃণমূল নেতা মিলন দত্তও। কিন্তু কেউই গাড়ি থেকে নামতে পারছিলেন না। সব ক’টি দরজাই ঠাসা ভিড়ে বন্ধ। গৌতমবাবু পুরোপুরি শান্ত ছিলেন। কোলের উপরে দু’টি হাত রেখে উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে তাকিয়েছিলেন সামনের দিকে। সেখানে গাড়ির গায়েই তখন উঠে পড়েছেন বহু বিক্ষোভকারী।
গাড়ির ভিতরে কেউই কোনও কথা বলছিলেন না। নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখছিলাম চোয়াল স্থির করে রাইফেল হাতে পাথরের মূর্তির মতো বসে। একটি করে মুহূর্ত যাচ্ছে, মনে হচ্ছে অনন্তকাল কাটল। নানা রংয়ের সোয়েটার পরা চেহারাগুলো জানলায় এসে উত্তেজিত মুখে কী বলছে তার কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল। বাকিটা বুঝে নিতে হচ্ছিল ভঙ্গিতে। তাতেই গা হিম হয়ে যাচ্ছিল। এই ভাবেই কত ক্ষণ কাটল, বোঝার ক্ষমতাও যেন চলে গিয়েছিল। তবু তার মধ্যেই অমিতবাবুর গলা শুনলাম। পুলিশ এসেছে। তাকিয়ে দেখি বাঁ দিকে ভিড় কিছুটা পাতলা হয়েছে। কিছু লোক উল্টো দিকে ছুটছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, সে দিক থেকে পুলিশকর্মীদেরও দেখা যাচ্ছে। মনে কিছুটা সাহস এল। গৌতমবাবু অবশ্য তখনও পুরোপুরি চুপ করে বসে। কাচ তোলা জানলা দিয়েই দেখলাম পুলিশের সঙ্গেও ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয়েছে ওই ভিড়ের। প্রচুর পুলিশকর্মীর চাপে আস্তে আস্তে অবশ্য পিছু হঠল উত্তেজিত জনতা। |