দায়সারা পুকুর খোঁড়ায় জলে কোটি টাকা
যে প্রকল্প পাঁচ বছরে শেষ করার কথা, মন্ত্রীর দাবি, তার ৯০ শতাংশই দেড় বছরে হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কাজটা কাজের মতো হয়নি। বেশির ভাগটাই জলে।
প্রসঙ্গ রাজ্যের বহু বিজ্ঞাপিত ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প। যার কথা প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে নিয়ম করে বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে প্রকল্প সম্পর্কে রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের দাবি, “পাঁচ বছরে রাজ্যে ৫০ হাজার পুকুর খনন করতে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রায় ৪২ হাজার ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। মে মাসের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হয়ে যাবে।”
কিন্তু যাঁরা সেই কাজ দেখেছেন, তাঁরা কী বলছেন?
বহু এলাকাতেই গ্রামবাসী অভিযোগ করছেন, তাড়াহুড়ো করে দায়সারা ভাবে বিধিবদ্ধ প্রযুক্তি বা নিয়ম না মেনে জলাশয়গুলো তৈরি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরাও সেগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। নদী ও ভূজল বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “কয়েকটি জেলায় দেখলাম প্রচুর নতুন পুকুর কাটা হয়েছে। কিন্তু না গভীরতা, না পাড় বাঁধানো কোনওটাই নিয়ম মেনে হয়নি। ভূগর্ভ জলস্তর পর্যন্ত কাটা না-হলে সারা বছর জল থাকবে না। পাড় ভাল করে না বাঁধালে বর্ষায় মাটি ধুয়ে নেমে পুকুর ভরাট হয়ে যাবে।”
পুকুর কাটার বেশির ভাগ কাজই হচ্ছে একশো দিনের প্রকল্পে। এবং সেখানেই গণ্ডগোলের অন্যতম কারণ নিহিত বলে মনে করছেন কল্যাণবাবু। তাঁর মতে, সাধারণ দিনমজুরদের পুকুর কাটার কাজে অজ্ঞতা এবং অনভিজ্ঞতার কারণেই গণ্ডগোল হচ্ছে। এখন যখন পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি পঞ্চায়েতের খাঁ-বাঁধের সংস্কার হচ্ছে, স্থানীয় যুবক প্রশান্ত মাহাতোও বলছেন, “মাটি কেটে পুকুরের পাড়েই ফেলা হচ্ছে। আগামী বর্ষায় ওই মাটি ফের পুকুরেই ঢুকে যাবে। তা হলে কী লাভ?”
একই অভিযোগ শোনা গিয়েছে পুরুলিয়া ২ ব্লকের ছড়রা-দুমদুমি পঞ্চায়েতের দুমদুমি গ্রামে সুদন গড়িয়া নামে একটি পুকুর খননের ক্ষেত্রেও। গ্রামের শ্রীকান্ত মাহাতোর অভিযোগ, “পুকুরের মাটি পাড়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু দুরমুশ দিয়ে সেই মাটি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে ঘাসের চাপড়াও লাগানো হচ্ছে না। এতে যেমন পাড় শক্তপোক্ত হচ্ছে না, তেমনই বর্ষায় ওই মাটি নেমে পুকুর ভরিয়ে দেবে।” হুড়া ব্লকের দলদলি পঞ্চায়েতের ফুফুন্দি গ্রামের মাঝি গড়িয়া নামে একটি পুকর খোঁড়া নিয়েও একই অভিযোগ তুলেছেন বাসিন্দারা।
বাঁকুড়ার জয়পুর ব্লকের গেলিয়া গ্রামের মানিকদিঘি ও ব্রাহ্মণপুকুর সংস্কার হয়ে যাওয়ার পরে আবার অন্য অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সংস্কারের কাজ কাগজে-কলমে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জলাশয়গুলি যত গভীর করার কথা ছিল, তা হয়নি। পাড় বাঁধানোও হয়নি। পুরুলিয়া জেলায় ১৫,৫৬৩টি নতুন পুকুর কাটা হয়েছে। বাঁকুড়ায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে ২৫টি পুকুর কাটা এবং ১৩টি চেকড্যাম গড়ার জন্য। কয়েকটির কাজ শুরু হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে এই আর্থিক বছরে ৪৩০০ পুকুর খনন হয়েছে। আরও ৩১০৫টির খননের কাজ চলছে। নদিয়ায় আবার একমাত্র হরিণঘাটা ব্লকের মগরা বিল সংস্কারের কাজ চলছে।
কেবল পুকুর কেটে বৃষ্টির জল ধরাই নয়, পুরনো প্রায় মজে যাওয়া পুকুর সংস্কার এবং বাড়ির ছাদের জল নীচে ট্যাঙ্কে ধরে শুখার সময়ে নানা কাজে ব্যবহার করাকেও ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। পুকুর কাটা যা-ও বা হয়েছে, বাড়ির ছাদ থেকে পড়া বৃষ্টির জল ধরার কাজ এগোয়নি। আবার দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে যতটুকু বা সাফলা এসেছে, উত্তরবঙ্গে তা-ও হয়নি। অনেক জায়গায় পঞ্চায়েত-প্রশাসনের কর্তারা ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রল্পের নামও শোনেননি।
ফালাকাটার বিডিও কৃষ্ণ কান্ত ঘোষ মেনে নেন, “এমন প্রকল্প কোথাও হয়েছে কী না, জানা নেই।” ফালাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ক্ষিতীশ রায়ও বলেন, “কোনও দফতর আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।” মাদারিহাট-বীরপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বিকাশ দাস বা ধূপগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চিন্তামোহন রায়েরও একই অবস্থা। তবে গুয়াবরনগর পঞ্চায়েতের প্রধান সুভাষ রায় জানান, গত বছর শ’খানেক পুকুর খনন হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধান দফতরের ৮ লক্ষ টাকা খরচে টোটোপাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ছাদের বৃষ্টির জল ধরে রাখার ট্যাঙ্ক হয়েছে। কোচবিহারের অবস্থা সামান্য ভাল। গত বছর ৭০০ নতুন পুকুর কাটা হয়েছে, সংস্কার হয়েছে ৮০০ পুকুর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প ঠিকঠাক রূপায়িত হলে গ্রামবাংলার মঙ্গল। কল্যাণবাবু বলেন, “ধরুন বীরভূম। সেখানে বছরে দেড় হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। অথচ বিস্তীর্ণ এলাকা এক ফসলি। বৃষ্টির জল ধরে রেখে পরে সেচের কাজে ব্যবহার করলে কৃষিচিত্রই বদলে যাবে।”
কিন্তু দায়সারা কাজের চেয়ে কিছু না করাই হয়তো শ্রেয়।

(সহ-প্রতিবেদন: স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত পাল ও সুমন ঘোষ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.