স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় • বিষ্ণুপুর |
যাত্রায়, উপন্যাসে, সিনেমায়, নাটকে বিষ্ণুপুরের রাজনর্তকী লালবাঈ উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও মজে যাচ্ছে তাঁর স্মৃতি জড়িত লালবাঁধ। মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুরের অন্যতম দ্রষ্টব্য এই বিরাট জলাশয় এখন সংস্কারের অভাবে তার শ্রী হারিয়েছে। কিন্তু লালবাঁধকে তাঁর পুরনো রূপ ফিরিয়ে দিতে নেই প্রশাসনের উদ্যোগ।
বাঁধের পিছনে জয়পুরের জঙ্গল। উল্টো দিকে বিজয় যোগাশ্রম ও সর্বমঙ্গলা মন্দিরের আটচালা। সবই আছে, নেই কেবল টলটলে সেই জলাশয়। এক সময় এই বাঁধেই নৌকাবিহার করতেন বিষ্ণুপুরের রাজা রঘুনাথ সিংহ। সঙ্গে থাকতেন তাঁর প্রেমিকা রাজনর্তকী লালবাঈ। কিন্তু রানি চন্দ্রপ্রভা নর্তকীর সঙ্গে রাজার এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। কথিত রয়েছে, তাঁর নির্দেশে ওই বাঁধের জলেই ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল প্রেমিক যুগলকে। পরে সেই রাজার চিতায় পুড়ে চন্দ্রপ্রভা হয়েছিলেন ‘পতিঘাতিনী সতী’। এ সবই ইতিহাস। ওই বাঁধের জলে লালবাঈকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে লোকমুখে তা পরিচিত হয়ে যায় লালবাঁধ নামে। |
বিলুপ্তির পথে। ঐতিহ্যবাহী লালবাঁধের এখনকার ছবি তুলেছেন শুভ্র মিত্র। |
বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের অনন্য কীর্তি টেরাকোটার শিল্প সমন্বিত মন্দির দেখতে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসেন। তাঁদের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে বাদ যায় না ঐতিহাসিক লালবাঁধও। কিন্তু বাঁধের বর্তমান দুর্দশা দেখে হতাশ হন তাঁরা। হতাশ স্থানীয় বাসিন্দারাও। বাঁধ সংস্কারের দাবিতে বেশ কয়েকবার তাঁরা সোচ্চার হলেও ঐতিহাসিক এই বাঁধকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে কোনও সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, ঐতিহাসিক এই বাঁধ কেবল দর্শনীয় স্থান নয়, প্রয়োজনের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এক সময় এর পরিষ্কার জল লোকে পান করতেন। এখনও বহু মানুষ এই বাঁধের জলেই স্নান সারেন।
১৯৬৮ সালের গেজেটিয়ার অনুযায়ী, এই বাঁধের আয়তন ছিল ৩০ হেক্টর। কিন্তু মজে গিয়ে সেই বাঁধ এখন ১০০ বিঘেয় এসে ঠেকেছে। বাঁধের বাকি অংশ এখন কৃষিজমি। সেখানে চলছে চাষবাস। আরও দেরি করে ফেললে এই ঐতিহাসিক বাঁধের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না বলে আশঙ্কা বাসিন্দাদের। বিষ্ণপুরের পুরাতত্ত্ববিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “মজে গিয়ে যে ভাবে আয়তন কমে যাচ্ছে লালবাঁধের, তা চিন্তার বিষয়। দ্রুত সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। কারণ বাঁধটি জল সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষার কাজে এলাকায় বিশেষ গুরুত্বপূণর্।”
বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান তথা রাজ্যের শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, “ওই জলাধার সংস্কার হওয়া অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই খাতে পুরসভার কোনও অর্থ বরাদ্দ নেই।” তাঁর অভিযোগ, বামফ্রন্ট পরিচালিত জেলা পরিষদের কাছে অনেকবার তিনি লালবাঁধ সংস্কারের জন্য জানিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। তাঁর আশ্বাস, “আমরা রাজ্যে সবে ক্ষমতায় এসেছি। তবু ইতিমধ্যেই পর্যটন উন্নয়নের পরিকল্পনায় লালবাঁধকে ঘিরে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই কিছু কাজ শুরু হয়ে যাবে।” একই আশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসক অদীপকুমার রায়ও। আপাতত ওই আশ্বাসই সহায় বিষ্ণুপুরের। |