অর্থ কমিশনের বহু টাকা ব্যবহারই হয়নি
কেন্দ্র ও রাজ্যের অর্থ কমিশনের দু’টি ক্ষেত্রেই বরাদ্দ টাকা খরচে অনেকটাই পিছিয়ে হুগলির পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলি। যার জেরে পরবর্তী বরাদ্দ আসছে না বলেই জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সব মিলিয়ে আখেরে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গ্রামীণ নাগরিকদেরই।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশনের ২০১১-১২ আর্থিক বছরে হুগলি জেলার পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েতগুলি মিলিয়ে প্রথম কিস্তির ৪৪ কোটি ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা পেয়েছিল। তার মধ্যে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৭ কোটি ৩২ লক্ষ ২১ হাজার টাকা। শতকরা হিসেবে যা ৬১.৮৫ শতাংশ। ত্রয়োদশ কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনে হুগলি বরাদ্দ হয়েছিল ৩৭ কোটি ৩৭ লক্ষ ৪৯ হাজার টাকা। খরচ হয়েছে ২৬ কোটি ৫৪ লক্ষ ৯০ হাজার। যা মূল বরাদ্দের ৭১.৩০ শতাংশ। সর্বত্রই টাকা খরচের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) শান্তনু মুখোপাধ্যায়।
রাজ্যের এই অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েতকে সম্মিলিত ভাবে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ খরচ করে শংসাপত্র দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু একক ভাবে কোনও পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েত সঠিক খরচ করতে পারলেও সমগ্র জেলা মানোত্তীর্ণ না হলে তারাও বঞ্চিত হবে। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ খরচের শংসাপত্র পাঠালে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পাওয়া যায়।
কেন্দ্র ও রাজ্যের অর্থ কমিশনের দু’টি ক্ষেত্রের তাৎপর্য কী?
স্থানীয় সরকার হিসাবে ১৯৫৯ সালে দেশে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সূচনার পরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাগরিকদের উন্নত পরিষেবা পাওয়ার দাবিও বেড়েছে। এ দিকে, নির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থই অনেক সময়ে চাহিদার তুলনায় কম পড়ে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯৫ সালে দশম কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি রাজ্যের প্রতি পঞ্চায়েতে জনসংখ্যার বিচারে কিছু টাকা ‘নিঃশর্ত তহবিল’ হিসাবে দেওয়া হবে। যা পঞ্চায়েতগুলি সাধারণ মানুষের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে খরচ করবে।
একই উদ্দেশে ২০০০-০১ সালে প্রথম রাজ্য অর্থ কমিশন চালু হয়। দু’টি অর্থ কমিশনের স্থায়ীত্ব পাঁচ বছর করে। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রতি বছর দুই কিস্তিতে বরাদ্দ টাকা দেওয়া হয়। যা ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের বরাদ্দকৃত টাকা মূলত পঞ্চায়েতের তৈরি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতি করা যায়। এ ক্ষেত্রে পরিষেবামূলক কাজকেই অগ্রাধিকার দিতে হয়। যেমন পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তা মেরামতি, গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রভৃতি। রাজ্য অর্থ কমিশনের টাকায় মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিকাঠামো, জীবিকার উন্নয়ন প্রভৃতি খাতে খরচ করা যায়। কিন্তু বেতন, যানবাহন কেনা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ বা প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ করার মতো কাজ করা যায় না।
দু’টি নিঃশর্ত তহবিল থেকেই দেদার টাকা খরচের জায়গা থাকা সত্ত্বেও হুগলি জেলায় কেন খরচ হচ্ছে না সেই টাকা?
বিডিও এবং পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশের বক্তব্যের নির্যাস, অর্থ কমিশনের টাকা খরচ সহজ। কিন্তু অনেকগুলি সমস্যায় তা গতি পাচ্ছে না এই জেলায়। পাণ্ডুয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের আব্দুস সামাদ যেমন বলেন, “গ্রামস্তরে রাজনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে যদি বা টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, কিন্তু ঠিকাদার ও শ্রমিকেরা কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে এখন মজুরি ১৩৬ টাকা। কিন্তু দু’টি অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে গ্রামে অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে মজুরি সেই ৮১ টাকাতেই পড়ে আছে। ফলে শ্রমিক পাওয়া মুশকিল।” খানাকুল ২ ব্লকের সভাপতি সিপিএমের কালীশঙ্কর চক্রবর্তীও একই সমস্যার কথা জানিয়েছেন। তাঁর আরও সংযোজন, “পঞ্চায়েত স্তরে যাঁরা কাজের পরিকল্পনা করবেন, সেই নির্মাণ সহায়ক পদ অনেকগুলি খালি। বাস্তুকারও নেই। আমাদের ১১টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ৫টিতেই নির্মাণ সহায়ক পদে কেউ নেই।” আরও একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতা, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বহু পঞ্চায়েতে গ্রাম সংসদ হচ্ছে না। সেখান থেকেই নতুন কাজের প্রস্তাব উঠে আসার কথা। পঞ্চায়েতে নিয়মিত বৈঠকও হচ্ছে না। এখনও বহু পঞ্চায়েত সদস্য ঘরছাড়া কিংবা হুমকির জেরে কাজে আসছেন না বলে দাবি কালীশঙ্করবাবুর।
পঞ্চায়েত প্রধানদের মধ্যে হরিপাল ব্লকের কৈকালা পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের বিকাশ ঘাঁটি বলেন, “গ্রাম সংসদ নিয়মিত না হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। আমরা তবু চেষ্টা করছি।” আবার তৃণমূলের দখলে থাকা সিঙ্গুর ব্লকের বলরামবাটি পঞ্চায়েতের প্রধান দুলালচন্দ্র কোলের বক্তব্য, “আমরা চেষ্টা করছি টাকা খরচের। কিন্তু ঠিকাদার মিলছে না।” কারণ হিসাবে তিনি জানান, পূর্ত দফতরের বেঁধে দেওয়া আগের দরের সঙ্গে বর্তমান বাজার দর মিলছে না।
একই পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক পলাশ বারিক বা কৈকালা পঞ্চায়েতের সুরেশ কুণ্ডুর অবশ্য বক্তব্য, “গ্রাম সংসদ নিয়মিত না হওয়াটা কারণ নয়। মূল বাধা শ্রমিক ও সরঞ্জামের দর নিয়ে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যও খরচে গতি আসছে না বলে মনে করেন পঞ্চায়েত কর্মীদের অনেকেই।
বিডিওরা অনেকেই আবার মনে করেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে অর্থ কমিশনের টাকা খরচে গুরুত্ব দিচ্ছে না পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলি। কারণ মজুরির অঙ্কে একশো দিনের কাজের বরাদ্দ অর্থ কমিশন থেকে অনেকটাই এগিয়ে। পঞ্চায়েতগুলিতে নিয়মিত বৈঠক না হওয়ায় পঞ্চায়েত সমিতিও কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। তারকেশ্বরের বিডিও সুমন মজুমদার অবশ্য বলেন, “আমরা দু’টি অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। প্রায় ৭০ শতাংশ টাকা দ্রুত খরচের জন্য পরিকল্পনা চলছে।”
দু’টি অর্থ কমিশনের টাকা খরচের ক্ষেত্রে এই জেলায় সব থেকে এগিয়ে আছে চণ্ডীতলা ১ ব্লকের পঞ্চায়েতগুলি।
তৃতীয় অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৭৯.৮৭ শতাংশ টাকা। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটি ৯৩.৭০ শতাংশ। চণ্ডীতলা ১ বিডিও পৃত্থীশ কুমার বলেন, “আমাদের কোনও অসুবিধা নেই। আরও কাজের পরিকল্পনা হয়েছে। আমরা আরও তহবিলের অপেক্ষায় আছি।”
১৮টা ব্লকের মধ্যে সব থেকে কম খরচ হয়েছে সিঙ্গুরে। রাজ্য অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে ২৭.১৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের ক্ষেত্রে ২৮.৬৪ শতাংশ। কেন টাকা খরচ করা যায়নি? সে প্রসঙ্গে না গিয়ে সিঙ্গুরের বিডিও বিষ্ণু কবিরাজ বলেন, “টাকা খরচের বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়েছে।”
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে যে ভাবে প্রশাসনিক কর্তাদের হাতে পঞ্চায়েত-স্তরেও ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন, তার সমালোচনা করে হুগলি জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা সিপিএম নেতা প্রদীপ সাহা বলেন, “পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। রাজনৈতিক উপদেষ্টারা কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। পঞ্চায়েত স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না।” অন্য দিকে, জেলা পরিষদের তৃণমূলের বিরোধী দলনেতা পরেশনাথ সামন্ত বলেন, “ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নিয়ে অনেক সময়ে আমাদের জানানোই হয় না।”
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি, যে যার মতো দায় এড়াচ্ছেন। আখেরে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.