রাজ্য কোন প্রকল্প করবে, কী ভাবে, রাজ্যকেই তা ঠিক করতে দেওয়া উচিত।
তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান বাড়ে, অপচয়ের আশঙ্কাও কমে।
বিবেক দেবরায় |
কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে আর্থিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে রাজ্যের উপর ছড়ি ঘোরায়, আগের লেখায় (‘কোন রাজ্য বিশেষ...’, ৩০-১) সে বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। আজ কেন্দ্রের এই কর্তৃত্বের আর একটা দিক নিয়ে লিখতে চাই।
যোজনা কমিশন বিভিন্ন রাজ্যের জন্য যে বরাদ্দ স্থির করে তার একটা অংশ নির্ধারিত হয় বিশেষ বণ্টন-সূত্র অনুসারে, কোন রাজ্য কী অনুপাতে টাকা পাবে সেটা জনসংখ্যা, দারিদ্র ইত্যাদি কতকগুলো নির্দিষ্ট মাপকাঠি অনুসারে স্থির করা হয়। অন্য একটা অংশ সূত্র-নির্ভর নয়, সেখানে যোজনা কমিশনের নিজস্ব বিবেচনার অবকাশ থাকে। এই ধরনের বরাদ্দ দেওয়া হয় দু’ধরনের প্রকল্প বাবদ:
(১) সেন্ট্রাল সেক্টর স্কিম বা কেন্দ্রীয় প্রকল্প এবং
(২) সেন্ট্রালি স্পনসর্ড স্কিম (সি এস এস) বা কেন্দ্রীয় সাহায্যে চালিত প্রকল্প। প্রথম ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা খুবই কম, বেশির ভাগ সূত্র-নিরপেক্ষ বরাদ্দই দেওয়া হয় দ্বিতীয় ধরনের প্রকল্প মারফত। লক্ষণীয়, এই সি এস এস বর্গের প্রকল্পে কেন্দ্র যে টাকা দেয়, রাজ্যগুলিকে তার সঙ্গে আনুপাতিক হারে টাকা দিতে হয়। একে চলতি কথায় বলা হয় ‘ম্যাচিং গ্রান্টস’। কিছু রাজ্য নানা কাঠামোগত কারণে খুব অসুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে তাদের বিশেষ গোত্রভুক্ত রাজ্য (স্পেশাল ক্যাটেগরি স্টেট) আখ্যা দেওয়া হয়। সেই রাজ্যগুলির এই সমানুপাতিক খরচের দায় থাকে না।
১৯৭০ সালে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (এন ডি সি) বা জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রাজ্য যোজনায় কেন্দ্রের মোট সাহায্যের ছ’ভাগের এক ভাগের বেশি সি এস এস মারফত দেওয়া উচিত নয়। আবার দশম পঞ্চবার্ষিক যোজনা (২০০২-০৭) তৈরির সময় যোজনা কমিশন বলেছিল, হাজারটা জিনিস করতে গিয়ে লেজেগোবরে না হয়ে কয়েকটা জিনিস ভাল করে করা ভাল; সে জন্য সি এস এস গোত্রের প্রকল্পের সংখ্যা অনেক কমানো দরকার। তখন এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা দুশোয় পৌঁছেছিল। কমিশন বলেছিল, খুব কঠোর ভাবে বাছাই করে সংখ্যাটাকে কুড়ি থেকে চল্লিশে নামিয়ে আনা দরকার এবং একশো কোটি টাকার নীচে কোনও প্রকল্প এই তালিকায় রাখাই উচিত নয়। |
অসমান? রাজ্য যোজনার পরিচালকদের সঙ্গে যোজনা কমিশনের বৈঠক। দিল্লি, ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ছবি: পি টি আই |
আমি আগের লেখায় কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক কমিশনের কথা উল্লেখ করেছি। সেই কমিশনও বলে, “সি এস এস-এর সংখ্যা যথাসম্ভব কম রাখা উচিত।... কোনও প্রকল্প প্রাথমিক পরীক্ষামূলক পর্ব সফল ভাবে উতরে গেলে এবং বড় আকারে রূপায়ণের যোগ্য বলে বিবেচিত হলে সেটি রাজ্য যোজনার অঙ্গ হবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজ্যগুলিকে প্রদত্ত কেন্দ্রীয় যোজনা বরাদ্দের যত কম অংশ সি এস এস খাতে রাখা যায়, ততই ভাল।” কার্যক্ষেত্রে এমন কিছুই করা হয়নি। সি এস এস-এর সংখ্যা ২২৫ থেকে যৎসামান্য কমে হয়েছে ১৯৫।
কেন্দ্রীয় সাহায্যে চালিত এই প্রকল্পগুলির দক্ষতার মান ভাল নয়, এগুলির সুফল ঠিক ভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়নি, তাদের লক্ষ্যও যথেষ্ট নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু তা ছাড়াও সমস্যা আছে। নীতিগত সমস্যা। প্রথমত, বিভিন্ন সি এস এস এমন বিষয়ের জন্য নির্ধারিত হয়, যেগুলি সংবিধানে রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে স্থির হয়েছিল, যে সমস্ত সি এস এস রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে জড়িত বলে সাব্যস্ত হবে, সে সবই রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু সে প্রস্তাব রূপায়িত হয়নি। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র যে টাকা দেয়, রাজ্যকে তার সঙ্গে আনুপাতিক হারে টাকা দিতে হয় বলে সি এস এস-এর জন্য রাজ্য সরকারের উপর চাপ পড়ে। তৃতীয়ত, রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়ে রাজ্যের উপর শর্ত আরোপ করা হয়; যেমন, জে এন এন ইউ আর এম প্রকল্পের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারি নিয়ম মেনে রাজ্য সরকার শতকরা ৫ টাকার বেশি স্ট্যাম্প ডিউটি ধার্য করতে পারে না, অথচ স্ট্যাম্প ডিউটি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। চতুর্থত, সি এস এস বাবদ বরাদ্দ অর্থ অনেক সময় রাজ্য সরকারকে পাশ কাটিয়ে স্বশাসিত সংস্থাকে দেওয়া হয়। কিছু কিছু সি এস এস-এর জন্য আলাদা আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করতে হয়। মোদ্দা কথা হল, যে টাকা রাজ্য সরকারের হাতে যেত, সি এস এস মারফত সেটা খরচ করার একতরফা অধিকার পায় কেন্দ্র।
সুতরাং, কেন্দ্রীয় সাহায্যে চালিত প্রকল্পগুলি কাটছাঁট করে রাজ্যের হাতে আরও বেশি পরিমাণে ‘সম্মিলিত’ অর্থ তুলে দেওয়া উচিত। প্রকল্পের অর্থ কোন কোন ক্ষেত্রে খরচ করা দরকার, সে বিষয়ে হয়তো একটা সাধারণ নির্দেশিকা থাকতে পারে, কিন্তু বাকিটা রাজ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিধেয়। যেমন, শিশু-মৃত্যু কমানোর জন্য বরাদ্দ অর্থ ঠিক কী ভাবে খরচ করা হবে, তার উত্তর কেরলে ও ঝাড়খণ্ডে এক না-ই হতে পারে। বস্তুত, শিশু-মৃত্যুর হার কমানোয় কতটা জোর দেওয়া জরুরি, তার মাত্রাও বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম হওয়া স্বাভাবিক, কারণ সমস্যাটির তীব্রতা সর্বত্র এক রকম নয়। অথচ সি এস এস নির্ধারিত হয় দিল্লিতে, কোন রাজ্যের সত্যই কী প্রয়োজন, কতটা প্রয়োজন, সে বিষয়ে কেন্দ্রের কর্তারা যথেষ্ট নজর দেন না। স্বাভাবিক ভাবেই, এই সব প্রকল্পের রূপায়ণে বিস্তর ঘাটতি থেকে যায়। সত্তরের দশক থেকে সি এস এসের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে এই ত্রুটিবিচ্যুতিও বেড়েছে। যখন সি এস এসের সংখ্যা কম ছিল তখন তাদের হাল এত খারাপ ছিল না।
দ্বাদশ যোজনা (২০১২-১৭) সম্প্রতি চূড়ান্ত হয়েছে। সেখানে সি এস এস সম্বন্ধে বলা হয়েছে, “সম্পদ যেহেতু সীমিত, তাই যোজনা-নির্ধারিত বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি ব্যয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার করার জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ জরুরি। এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে সি এস এস’গুলির সংস্কার ও দক্ষতা বাড়ানোর উপায় খোঁজার জন্য যোজনা কমিশন তার অন্যতম সদস্য বি কে চতুর্বেদীর নেতৃত্বে একটি কমিটি বসিয়েছিল। এই প্রকল্পগুলির সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর বেড়েছে। অনেক প্রকল্পই আয়তনে খুব ছোট। চতুর্বেদী কমিটি সুপারিশ করে, সি এস এস-এর সংখ্যা অনেক কমিয়ে ফেলা দরকার এবং যে সব নির্দেশিকা মেনে এই প্রকল্পগুলি রূপায়ণ করতে হয় সেগুলি অনেক নমনীয় করা দরকার। কেন্দ্রের নানা মন্ত্রক এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সঙ্গে এই সব সুপারিশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তাঁরা সামগ্রিক ভাবে এগুলিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ২০১৩-১৪ থেকে এই সুপারিশগুলি রূপায়ণের প্রস্তাব করা হচ্ছে।”
কমিটি রিপোর্ট দেয় ২০১১ সালে। তার রূপায়ণ ২০১৩-১৪’য় পিছিয়ে দেওয়া হল। সি এস এস-এর সংখ্যা কমানোর ব্যাপারেই বা কী ঠিক হল? সংক্ষেপে বললে, এখন ১৪৭টি সি এস এস চালু আছে, তাদের তিন ভাগে ভাগ করে মোট প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে ৫৯ করা হবে, এটাই স্থির হয়েছে।
৫৯ সংখ্যাটাও মোটেই কম নয়। আমরা এখনও কেন্দ্রীয় সাহায্যে চালিত প্রকল্পের সংখ্যা যথেষ্ট কমাতে প্রস্তুত নই। কেন্দ্র থেকে রাজ্যের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার পদক্ষেপটি করতে আমরা এখনও অপারগ। অথচ এটাই জরুরি। রাজ্যের মধ্যেও নীচের স্তরে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। সরকার যত টাকা খরচ করা হয় কেন তার সমানুপাতিক সুফল পাওয়া যায় না, এই প্রশ্ন যখন এর পর আপনাকে তাড়না করবে, তখন এটা খেয়াল করবেন যে, সরকারি ব্যয়ের একটা বড় অংশ প্রকল্প চালানোর প্রশাসনিক খরচ মেটাতেই চলে যায়। রাজীব গাঁধী বলেছিলেন, সরকার যত টাকা খরচ করে তার ১৫ শতাংশ ঠিক জায়গায় পৌঁছয়। এটা কিন্তু ভাববেন না যে, বাকি ৮৫ শতাংশের পুরোটাই দুর্নীতির গ্রাসে চলে যায়। প্রশাসনিক খরচও এই অপচয়ের একটা বড় কারণ। এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন রাজ্যে যে সব প্রকল্প চালায়, সেগুলি থেকে সরে এসে যদি তাদের পুরোপুরি রাজ্যের হাতে ছেড়ে দেয়, টাকাটাও তাদের হাতে দিয়ে দেয়, তা হলে এই প্রশাসনিক খরচও অনেক কমে যেতে পারে, সরকারি ব্যয়বরাদ্দের সুফল অনেক বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এটা বিকেন্দ্রীকরণের একটা বড় যুক্তি। কেন্দ্রীয় সরকার এ যুক্তি কতটা মানতে রাজি, কতটা কার্যকর করতে প্রস্তুত, সেটা খুব বড় প্রশ্ন। |
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতির শিক্ষক |