গোর্খাল্যান্ডের দাবি বর্তমানে প্রকট হয়ে উঠেছে। (‘গোর্খাল্যান্ডের দাবি...’ (৪-২) এ নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এই আলোচনা থেকে দুটো বিষয় উঠে এসেছে বলে আমার মনে হয়।
প্রথমত, অনেকের মতে ভারতে বসবাসকারী নেপালিদের গোর্খাল্যান্ডের দাবি ১০৭ বছরের পুরনো। তাই এই দাবি ন্যায্য। শুধুমাত্র পুরনো দিনের দাবি বলে কী করে তা ন্যায্য হয়ে যায়?
আরও বলা হচ্ছে, গোর্র্খাল্যান্ডের দাবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেপালিদের ‘জাতিসত্তা’ বা ‘আত্মপরিচয়’ এবং ‘আবেগ’। তাই দাবি, দার্জিলিঙে বসবাসকারী নেপালিদের জাতিসত্তা রক্ষার্থে গোর্খাল্যান্ড দিতেই হবে। এখানে কতকগুলি বিষয় দেখার আছে। দার্জিলিঙের নেপালিরা, যাঁরা নিজেদের গোর্র্খা বলে দাবি করছেন, তাঁরা কীসের ভিত্তিতে গোর্খা? গোর্র্খা বলে কোনও জাতি ইতিহাসে ছিল না। গোর্খা ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই। নেপালে গোর্খা বলে একটা জেলা আছে। সেই জেলা থেকে ব্রিটিশ সরকার কিছু নেপালিকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী গঠন করে এবং ওই জেলার নাম অনুসারেই সেই সেনাবাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘গোর্খা রেজিমেন্ট’ এবং গোর্র্খা রেজিমেন্টের সৈন্য বলে ওই নেপালি সৈন্যদের ‘গোর্খা সৈন্য’ বলা হত। |
গোর্র্খাল্যান্ডের দাবির আলোচনায় আর একটি বিষয় উঠে এসেছেতা হল, গোর্খাল্যান্ড নেপালি জনজাতির আবেগের ব্যাপার। কেবলমাত্র আবেগের উপর ভিত্তি করে কি একটা রাজ্য গঠিত হতে পারে? একটা রাজ্য গঠন করতে হলে তার জনসংখ্যার পরিমাণ, ভৌগোলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক দিকগুলিও অধিক বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত, নেপালিরা শুধুমাত্র দার্জিলিঙেই বসবাস করেন না, বরং ভারতের সর্বত্রই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, গুজরাত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যেই তাঁদের বাস। তবে অধিকসংখ্যক নেপালি বাস করেন আলমোড়া, গাড়োয়াল, দেরাদুন ইত্যাদি নেপাল-সন্নিহিত এলাকায়। এখন, দার্জিলিঙে যদি গোর্খাল্যান্ড হয় শুধুমাত্র দার্জিলিঙের নেপালিদের জন্য, তা হলে বাকি নেপালিদের আত্মপরিচয় বা জাতিসত্তার কী হবে? সে ক্ষেত্রে, ভারতে বসবাসকারী সকল নেপালি কি তাঁদের আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তা রক্ষার্থে দার্জিলিং অর্থাৎ গোর্খাল্যান্ডে এসে বাস করতে শুরু করবেন?
তাই, যাঁরা বঙ্গভঙ্গ করে গোর্খাল্যান্ড দিতে অত্যুৎসাহী, তাঁদের এই বিষয়গুলি ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। আমরা সমস্যা সমাধানের কথা বলতে গিয়ে সমস্যার গভীরে কেন যেতে চাইছি না? দার্জিলিংয়ে বসবাসকারী বাঙালিরা কেন দার্জিলিং ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন? একটা গোষ্ঠীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করলে তার অধীনে লেপচা এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুরা কি ভবিষ্যতে ভাল থাকবেন? তাঁদের অস্তিত্ব কি সুরক্ষিত থাকবে? সিকিমের উদাহরণ কিন্তু তা বলে না।
স্মৃতিকণা মজুমদার। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, কলকাতা-৬৪
|
পাহাড়ে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠছে। এ দিকে তেলেঙ্গানা ইস্যুও মোর্চা নেতৃত্বের কাছে হাতে-গরম রসদ। আবার সেই বাংলা ভাগের তীব্র রাজনীতির দোলাচলে পাহাড় সংলগ্ন সমতল, তরাই-ডুয়ার্স এবং শিলিগুড়ি উত্তপ্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা। সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এখন চান, মুখ্যমন্ত্রীর ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ রূপটা দেখতে। পাহাড়ে তৃণমূল, সি পি এম, কংগ্রেস কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু মোর্চাকে বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন অলীক কল্পনা। টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠন-পর্বে ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটা জুড়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমাহীন ভুল করেছিলেন। এ বার আবেগ-ইগো বিসর্জন দিয়ে শিলিগুড়ি মহকুমাকে আইন মোতাবেক জেলা স্তরে উন্নীত করুন। রাজ্যের হাতে রাশ রেখে পাহাড়ের স্বায়ত্তশাসন এমন ভাবে ন্যস্ত করুন মোর্চার হাতে, যাতে শেষরক্ষা হয়।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী। কলকাতা-১২৫ |