সম্প্রতি একাধিক বার কলকাতায় এসেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের
এমেরিটাস অধ্যাপক, সে দেশের বাংলা আকাদেমির সভাপতি। আনিসুজ্জামান। কখনও ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ
আয়োজিত সম্মেলনে বক্তা হিসেবে, কখনও কলকাতা বইমেলা-র উদ্বোধক। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক
ঘটনাবলি এবং দু’পারের সংযোগের গুরুত্ব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন
সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী |
গত ক’সপ্তাহে বাংলাদেশের জনসাধারণ যে ভাবে পথে নেমে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবি করেছেন, তাকে কি এক নতুন জনজাগরণ বলা যায়?
এটা সত্যিই এক বড় ঘটনা। মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে প্রথমে রাজধানী ঢাকায় এবং পরে সারা বাংলাদেশে তরুণ সমাজ কয়েক দিন ধরে দিনরাত্রি অবিরাম বিক্ষোভ করে চলেছেন। তাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রণোদিত নন, দেশের প্রতি ভালবাসা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি আনুগত্য দ্বারা পরিচালিত। এটি এক অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। ১৯৭১ সালের পর, মনে হয়, এমনটা দেখা যায়নি। যাঁরা এর উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁরা এখনও নাগরিক সমাজের অংশ হয়ে ওঠেননি তাঁরা ছাত্র ও যুবক। কিন্তু তাঁদের সমর্থনে এসে দাঁড়িয়েছেন সকল শ্রেণির নরনারী, সাধারণ মানুষ সত্যিকারের নাগরিক সমাজ। তাঁদের দাবি যদিও বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, কিন্তু ভাবাবেগটা তাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। না দেখলে এই জাগরণকে পুরো বোঝা যাবে না।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নাগরিক সমাজ তো বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আবার ইদানীং কালে কোনও কোনও সময়ে তার কাজকর্ম নিয়ে অনেক ধরনের কথাবার্তা শোনা গেছে। আপনি কি নাগরিক সমাজের ভূমিকায় সত্যি কোনও পরিবর্তন দেখছেন?
পরিবর্তন কিছুটা হয়েছে। আগে নাগরিক সমাজ তার কাজকর্মের মধ্য দিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চেষ্টা করত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই মানুষের নানা অধিকারের দাবি তুলে ধরতে সরব হত। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে নিজের পৃথক সত্তাকে বিসর্জন দিত না। পরে অনেক সময় দেখা গেছে যে, নাগরিক সমাজের সদস্যরা রাজনৈতিক দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছেন। কেউ যদি আওয়ামী লিগের পাশে দাঁড়ান তো অন্য জন্য বি এন পি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি)-কে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন। এতে নাগরিক সমাজের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়। এই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গেও ইদানীং বেশ প্রকট। নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট সদস্যরা এখানেও কোনও-না-কোনও দলীয় পরিসরে প্রায়ই বন্দি হয়ে পড়ছেন। বিভিন্ন দলের নেতা বা সমর্থকেরাও যেন তাঁদের মতো করে চিন্তাবিদদের দলীয় পরিচয়ে দেগে দিচ্ছেন। এই ব্যাপারে দুই বাংলার অদ্ভুত মিল।
এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিছুটা হয়তো ব্যাখ্যা করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চিন্তাবিদদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করা। নিজেদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি তাঁদের কাছে তখন ছিল গৌণ। পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ সেই লক্ষ্যপূরণের পরেও সেনা-শাসনের অবসানের দাবিতে নাগরিক সমাজ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের পরে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছিল। অনেকেই বহু ক্ষেত্রে ছোটখাটো চাওয়াপাওয়ার বিষয়ে বেশ আগ্রহী। এতে চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্র কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে তো বটেই! চিন্তার পিছনে আগের সেই আবেগ, ভালবাসা বা প্যাশনের জায়গা নিতে শুরু করেছিল বিভিন্ন বৈষয়িক ভাবনা। এই স্বার্থচিন্তাও নাগরিক সমাজের ভূমিকাকে বদলেছে, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়েছে। মনে রেখো, এই ব্যাপারে আজকের ভোগবাদী সমাজও কম দায়ী নয়। |
জনজাগরণ। যুদ্ধাপরাধীদের উচিত শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ। ঢাকা, ৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এ পি |
এই বিচারের প্রসঙ্গে অন্য একটা কথা বলি। বাংলাদেশের বিহারি মুসলমানদের কথা। তাঁরা শরণার্থীও নন, দেশের মধ্যে উচ্ছেদ হওয়া মানুষও নন। অথচ উপর্যুপরি দেশভাগ তাঁদের রাষ্ট্রবিহীন মানুষে রূপান্তরিত করেছে। এঁরাও তো এক অর্থে নিজভূমে পরবাসী। এঁরাও তো ন্যায়বিচারের দাবিদার।
এই মানুষের মধ্যে একটি প্রজন্মের অংশবিশেষ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সরকার ও সেনার পক্ষ নিয়েছিলেন। তাদের চর হিসেবেও কেউ কেউ কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা এঁদের ‘রাজাকার’ বলেই ভাবেন। এঁদের আর আজকের পাকিস্তান বা ভারতের নাগরিকতা পাবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এই বিহারিদের নতুন যে প্রজন্ম যাঁরা স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের মাটিতে জন্মেছেন, তাঁদের অনেকেই ক্রমশ নাগরিকতা পেতে শুরু করেছেন। আগের মতো শিবিরে থাকবার প্রবণতাও এঁদের মধ্যে কমছে। আসলে দেশভাগের ইতিহাস ও যন্ত্রণা থেকে এই উপমহাদেশের মানুষ তো আজও মুক্ত হতে পারেননি।
দেশভাগের ফলে দুই বাংলার ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে কিছুটা ফারাকও তো তৈরি হয়েছে...
নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে সেটা হওয়ার কথাই ছিল। দুই বাংলার সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনার মধ্য দিয়েও এই ভিন্নতা এসেছে। এই ধরনের ভিন্নতা, স্বাতন্ত্র্য তৈরি করলেও দূরত্ব বাড়ায় না কিন্তু। নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পরস্পরকে সম্মান করবার মধ্য দিয়েই তো সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। তা ছাড়া, ভাষাগত ব্যবধান এবং ভিন্নতা সত্ত্বেও দুই বাংলার মধ্যে লেনদেনের সম্ভাবনা অপরিসীম।
দুই বাংলার মধ্যে লেনদেন, সেতুবন্ধন আজ কী ভাবে সম্ভব?
সামাজিক-সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্র তো রয়েছেই। এর সঙ্গে রয়েছে ভৌগোলিক নৈকট্য। দেশভাগের মধ্য দিয়ে দুই বাংলার অর্থনীতিই এক সময়ে বিপন্ন হয়েছিল। কিন্তু আজ নতুন ভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। সে নদীর জল বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদই হোক, বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীই হোক লেনদেনের সম্ভাবনা সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। এই লেনদেন শুধু দুই বাংলা নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সক্ষম। সর্বোপরি রয়েছে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের প্রসঙ্গ। পারস্পরিক যাতায়াত দুই দেশের মধ্যে, দুই বাংলার মধ্যে বোঝাপড়া অনেক গুণ বাড়াতে পারে। ধরা যাক, এখানের কোনও রাজনৈতিক নেতা বলে বসলেন যে, এ পার থেকে এক ছটাক চালও বাংলাদেশে যেতে দেব না। তা হলে অবিশ্বাস বাড়ে, সম্পর্ক দুর্বল হয়। সেটা দুই বাংলা এবং দুই দেশেরই ক্ষতি করে। সোজা পথে চালের জোগান বন্ধ হলে অন্য পথ খুলে যায়। হয়তো তৃতীয় কোনও দেশের মধ্য দিয়েও চাল যায়। এতে প্রয়োজন হয়তো মেটে, কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে।
এক সময়ে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ চার দশক বাদে বাংলাদেশ নিয়ে, দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কি কোনও স্বপ্ন দেখেন?
স্বপ্ন এখনও দেখি। দেখি যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দারিদ্র, অশিক্ষা ও অন্যান্য অভাব-অনটন অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আর এই বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এবং ভারতবর্ষের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া শান্তি সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অঞ্চল বলে পরিচিত হয়েছে। ‘সার্ক’ বলে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল প্রায় ত্রিশ বছর আগে। অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল তাকে ঘিরে, অথচ সেই আঞ্চলিক সংগঠন এখনও এই অঞ্চলের মানুষের আশা পূরণ করতে পারেনি। ইউরোপের অধিবাসীদের মতো আমাদের অঞ্চলের এক দেশের মানুষ বিনা বাধায় অন্য দেশে যেতে পারবেন, আমাদের এই অঞ্চলের দেশগুলো হয়তো তার জন্য এখনও তৈরি নয়। তবে মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, আদানপ্রদান বাড়লে তার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ধরনও তো শেষে বদলায়। আর, মনে রাখতে হবে, মানুষের ঐক্য আর বোঝাপড়াই কিন্তু স্বৈরাচার, সন্ত্রাস আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। |