মুখ নেই, স্লোগান আছে,
পরিবর্তন নিয়ে টানাটানি

তোরা যে যা বলিস ভাই, মোদের পরিবর্তন চাই!
তার জন্য অতি দরিদ্রদের বিনা পয়সায় চাল, বেকারদের ভাতা, প্রথম বিভাগে পাশ-করা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ যা লাগে, দিতে প্রস্তুত কংগ্রেস! জনমোহিনী ইস্তাহারের প্রধান কিছু প্রতিশ্রুতি মহল্লায় মহল্লায় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্যাবলো ঘুরছে পাড়া থেকে গলিতে। ‘পরিবর্তন চাই’-এর ব্যানারে, পোস্টারে গোটা ত্রিপুরাই মুড়ে দিয়েছে কংগ্রেস! পরিবর্তনের প্রতীক্ষায় প্রদেশ কংগ্রেস ভবন চত্বরে শুরু হয়েছে রীতিমতো কাউন্টডাউন। ভোটের দিকে একটা করে দিন এগোচ্ছে আর কাপড়ে এঁটে রাখা সংখ্যা কমে যাচ্ছে ১০,৯, ৮, ৭...।
কিন্তু পরিবর্তন চাইতেই বিপত্তি! পরিবর্তনের স্লোগানের পেটেন্ট এত দিনে জনতা তুলে দিয়ে বসে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। আর এখানে কি না তাঁর তৃণমূলের প্রার্থীই নেই! খোঁচা দিতে জন্য এর চেয়ে বড় হাতিয়ার আর কী হতে পারত সিপিএমের কাছে? টানা কুড়ি বছরের শাসক দল তাই কটাক্ষ করে বেড়াচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্লোগান ধার করে এনে ভোট করতে হচ্ছে কংগ্রেসকে! ময়দানে না-থেকেও আড়াল থেকে হাসছেন ত্রিপুরা তৃণমূলের নেতারাও। বলছেন, মমতাকে এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে শেষ পর্যন্ত সিপিএমের শাসন মুক্তির ডাক দিতে তাঁরই মন্ত্র আমদানি করতে হল তো সনিয়া গাঁধীর দলকে?
বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়। পরিবর্তনের হয়ে সওয়াল করতে ত্রিপুরা কংগ্রেস প্রচারে নামিয়েছে দীপা দাশমুন্সি, মানস ভুঁইয়া, আব্দুল মান্নানের মতো পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের। এসেছেন যুব কংগ্রেসের এক দল নেতাও। নিজেদের রাজ্যে যাঁরা পরিবর্তনের উল্টো ফলের বিরুদ্ধে পথে, তাঁদেরই ত্রিপুরায় এসে পরিবর্তনের জন্য গলা ফাটাতে হচ্ছে! তা-ই দেখে বাংলা থেকেই প্রচারে আসা সিপিএম নেতারা কংগ্রেসকে আরও কটাক্ষে ভরিয়ে দিচ্ছেন!
পরিবর্তনের কাউন্টডাউন। মঙ্গলবার। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী
বিড়ম্বনা অবশ্য তৃণমূলেরও কিছু কম নয়। একে তো সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করার ময়দান পেয়েও সরে যাওয়ার অস্বস্তি। তার উপরে নিজেদের প্রার্থী যখন নেই, তখন কংগ্রেসকেই তলে তলে সমর্থন করা উচিত কি না, তা নিয়েও দলে দ্বন্দ্ব। ত্রিপুরা রাজ্য তৃণমূলের অ্যাড-হক কমিটির চেয়ারম্যান অরুণ ভৌমিক বলছেন, “যে কোনও কারণেই হোক, আমরা প্রার্থী দিতে পারিনি। আমি কর্মী-সমর্থকদের বলে দিচ্ছি কংগ্রেসকে ভোট দিতে। আমি নিজেও তা-ই দেব। তাতে যা পরিণাম হওয়ার, হবে!” আইনজীবী অরুণবাবুর সাফ কথা, “আমরা তো কংগ্রেস থেকেই এসেছি। গায়ে কংগ্রেসেরই রক্ত! পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস নেতারা ঠিকমতো সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়তে পারছিলেন না বলেই দিদিকে তৃণমূল করতে হয়েছিল। এখানেও প্রশ্নটা সিপিএম-বিরোধিতার।” আবার তৃণমূলেরই পুরনো কমিটির রাজ্য সভাপতি মানিক দেব বলছেন, “সিপিএম এবং কংগ্রেস থেকে আমাদের সমদূরত্ব রাখতে হবে এ বারের নির্বাচনে।”
নানা জেলার রাস্তাঘাটে তৃণমূলের কিছু ব্যানার চোখে পড়ছে। অরুণবাবু ও মানিকবাবু, দু’জনেই অভিযোগ করছেন, ব্যানার এবং কোথাও কোথাও তৃণমূল নেত্রীর ছবি নিয়ে মিছিল করে ঘোর অন্যায় করছে কংগ্রেস! কিন্তু তাঁদের কোনও প্রার্থী নেই বলে তৃণমূল নেতৃত্ব এই নিয়ে হইচই করে নির্বাচন কমিশনে যাচ্ছেন না। মানিকবাবুর কথায়, “ইউপিএ-তে থাকতে থাকতেই দু’বছর ধরে যখন কংগ্রেসের সঙ্গে এখানে কথা বলতে চেয়েছি, ওরা পাত্তা দেয়নি। এখন ভোটের সময় এসে পরিবর্তনের স্লোগান ধার করেছে!” স্লোগান যখন এসেছে, স্লোগানের জনক দলের নেতা-নেত্রীরাও কি আসতে পারতেন না? অরুণবাবুর জবাব, “ত্রিপুরার মানুষের মনের এক্স-রে করলে মমতার ছবি পাবেন! তিনি তো সর্বময়! ওমনি-প্রেজেন্ট!”
ব্যাপার-স্যাপার দেখে তির্যক মন্তব্য করতে ছাড়ছেন না সিপিএম নেতৃত্ব। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার যেমন বলছেন, “যারা পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে বাংলায় পরিবর্তনের সরকার করল, তাদের স্লোগান ধার করে এ আপনারা কী বলছেন? যাদের স্লোগান, তারা তো দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না! আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পরিবর্তনের পরিবর্তন চাইছে!” ত্রিপুরা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দাসের মত, গত বারের বিধানসভা ভোটে কিছু আসনে জামানত খুইয়ে তৃণমূল এ বার ঝুঁকি নেয়নি! পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলছেন, “ঘরপোড়া গরুর মতো ঘরপোড়া মানুষের কথা আমরা শুনছি ওখানে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বলছেন কান মুলছি, অন্যায় হয়েছে! আর না! এমন পরিবর্তন চাইনি। কংগ্রেসের যে নেতারা এখানে পরিবর্তনের কথা বলছেন, তাদের কানে কথাটা পৌঁছে দেবেন!” পশ্চিমবঙ্গেরই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, “কে কার বি টিম, এই নিয়ে এত দিন তর্ক হত! এখানে তৃণমূল হয়ে গিয়েছে সি টিম! ময়দান ছেড়ে একেবারে গ্যালারিতে চলে গিয়েছে!”
এত সব কটাক্ষের জবাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুদীপ রায়বর্মন টেবিল চাপড়ে বলছেন, “স্লোগান আমরা ধার করিনি! পরিবর্তনের একটা প্রতিশব্দ সিপিএম দিক! সেটাই বলব। ওঁরাও পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রত্যাবর্তন বলা ছেড়ে দিন!” ত্রিপুরাবাসীর মনোভাব আঁচ করে তৃণমূল যে প্রার্থী দিয়ে রসভঙ্গ করতে চায়নি, তার জন্য তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলছেন না সুদীপবাবু। বঙ্গের তৃণমূলের মতোই বলছেন, ক্ষমতায় এলে দলতন্ত্রের অবসান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। স্লোগান না হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে আনেননি। কিন্তু ‘পরিবর্তন চাই’ বলছেনই বা কেন? প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সমীররঞ্জন বর্মণের যুক্তি, “কেন-টেন কিছু না! মানুষ পরিবর্তন চাইছে!” একই বক্তব্য দীপারও। বলছেন, “মানুষ চাইছেন পরিবর্তন। আমরা সেই আকাঙ্খাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি।” আরও বলছেন, “কুড়ি বছর ধরে রুটির একটা দিকই সেঁকা হয়েছে। এ বার রুটিটা উল্টে দিন!” অর্থাৎ পরিবর্তনের ডাককে হেঁশেলে পৌঁছে দিতে চাইছেন দীপা।
গত বার কংগ্রেস রব তুলেছিল, ‘আইয়্যা পড়িত্যাছি’! শেষ পর্যন্ত ৬০ আসনের বিধানসভায় ৪৯ পেয়ে ক্ষমতায় এসে পড়ে বামফ্রন্ট। এ বার পরিবর্তনের ‘মুখ’ নেই, স্লোগান আছে। মমতার ভূমিকা ছাড়াই সিপিএম-দুর্গে ধাক্কা দেবে কংগ্রেস? নাকি কেন্দ্রে পরিবর্তনের লড়াই ত্রিপুরা থেকেই আরও একটু জোরালো হল বলে বিবৃতি দেবেন মানিক সরকারেরা? উত্তর ২৮ ফেব্রুয়ারি!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.