কলেজ নির্বাচন উপলক্ষ মাত্র। বন্দর সংলগ্ন গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজে মূল লড়াইটা তোলাবাজি এবং সেই সংক্রান্ত এলাকা দখল ঘিরে। সেই লড়াইয়ের ময়দানে এলাকার কিছু পরিচিত মুখ বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক জামা বদলায়। হরিমোহন ঘোষ কলেজ এই ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে। তাই এলাকা দখলের সেই লড়াই এই কলেজের নির্বাচনেও ছায়া ফেলে।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষে প্রকাশ্যেই জড়িয়ে পড়েন এলাকার কংগ্রেস ও তৃণমূল নেতারা। যার জেরে চলেছে বোমা-গুলি, প্রাণ গিয়েছে এক পুলিশকর্মীর। এ দিনের ঘটনায় দু’টি নাম সামনে এসেছে— স্থানীয় কংগ্রেস নেতা মোক্তার আহমেদ এবং ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না। অভিযোগ, এ দিনের সংঘর্ষের পিছনে রয়েছে এঁদেরই রাজনৈতিক টানাপোড়েন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, পুরসভার ১৩৩ থেকে ১৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেস নেতা মোক্তার আহমেদ রীতিমতো প্রভাবশালী। গার্ডেনরিচে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ থেকে এলাকায় নির্মাণকাজ অথবা রাস্তায় গাড়ি পার্কিং সব ব্যবসাই কার্যত নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। আদতে মোক্তার ছিলেন সিপিএমের নেতা। এলাকার সিপিএম নেতা দিলীপ সেনের ছায়াসঙ্গী মোক্তার বছর দেড়েক আগে সিপিএম ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন।
আবার এই এলাকাতেই তৃণমূল মহম্মদ ইকবাল এবং মেয়র পারিষদ সামসুজ্জামান আনসারির অধীনে দু’টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তৃণমূলের অন্দরে শোনা যায়, এঁদের পিছনে দলেরই দুই বড় মাথা রয়েছেন।
আনসারির মেয়ের বিয়ে হয়েছে মোক্তারের ছেলের সঙ্গে। অর্থাৎ, আত্মীয়তার সূত্রে আনসারি ও মোক্তার এখন এক গোষ্ঠী। এলাকায় ‘দাপট’ রাখার ক্ষেত্রে তাঁরা অলিখিত ভাবে একজোট। এঁদের সঙ্গে সরাসরি না হলেও পরোক্ষ ভাবে আছেন আনসারির ভাই চুন্নু। তিনি সিপিএম কাউন্সিলর। যিনি এক সময়ে এলাকায় কার্যত ‘শেষ কথা’ বলতেন। |
|
|
|
মোক্তার আহমেদ |
সামসুজ্জামান আনসারি |
মহম্মদ ইকবাল |
|
তৃণমূলের অপর গোষ্ঠীর ইকবাল এক সময়ে মমতা-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মোগলের ভাই। ফলে ইকবাল ও মোক্তারের লড়াই উপর থেকে কংগ্রেস-তৃণমূলের লড়াই বলে মনে হলেও সমান্তরালে প্রচ্ছন্ন ভাবে রয়েছে তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের স্রোত। যা আসলে বন্দর এলাকায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার লড়াই। লড়তে গেলে উভয়ের হাতেই অস্ত্র, বোমা সবই থাকে। আর সে সবই পৌঁছে যাচ্ছে কলেজের নির্বাচনে।
তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, বন্দর এলাকায় বরাবরই সিপিএম ও কংগ্রেস নেতাদের আশ্রয়েই চলত মাফিয়ারাজ। কিন্তু গত পুরসভা নির্বাচনের সময় কংগ্রেস ও সিপিএমের পালের হাওয়া টানতে বন্দর এলাকায় বছর দশেক আগে খুন হওয়া কংগ্রেস নেতা মোগলের ভাই মহম্মদ ইকবালকে তৃণমূলের প্রার্থী করা হয়। এলাকার এক তৃণমূল নেতা বলেন, “দলের শীর্ষ নেতারা বন্দর এলাকায় আনসারি পরিবার ও মোক্তারের ক্ষমতা খর্ব করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বন্দর এলাকায় মহম্মদ ইকবালই মোক্তার ও আনসারি পরিবারকে বেগ দিতে পারবে, তা জানার পরেই ইকবালকে পুরভোটে তৃণমূলের প্রার্থী করা হয়।” ইকবাল বরো চেয়ারম্যান হওয়ার পরে সিপিএম ও কংগ্রেস ছেড়ে বহু দুষ্কৃতীই তৃণমূলে আশ্রয় নেয়। মহম্মদ ইকবাল ওই এলাকা দখল করতে থাকেন। সিপিএম-আশ্রিত মোক্তার কিছুটা কোণঠাসা হতে থাকেন। বিধানসভা নির্বাচনের পরে মোক্তার সিপিএম ছেড়ে কংগ্রেসে আসেন। সম্প্রতি আত্মীয়তার সূত্রে আনসারি-মোক্তার কাছাকাছি, অলিখিত ভাবে একজোট।
অন্য দিকে, এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে তৃণমূল থেকে বহু কর্মী কংগ্রেসে যোগ দিতে থাকেন। সম্প্রতি বন্দর এলাকায় ইকবালের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কিছুটা পিছু হটতে থাকে। এখন তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে হাতিয়ার করে আনসারি পরিবার ও মোক্তার একজোট হয়ে ফের এলাকা দখলের খেলায় নেমেছে বলে তৃণমূলের অন্দরে খবর। এলাকায় আনসারির সমর্থকদের এখনও দাবি, আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য তাঁদেরই দলের অন্য গোষ্ঠীর ভূমিকা কম নয়। পাল্টা দাবিও আছে।
হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ এখন টিএমসিপি-র দখলে রয়েছে। এলাকা দখলের লড়াইয়ে তাই এই কলেজের নির্বাচনকেই টার্গেট করে মোক্তার ও আনসারি পরিবার। মোক্তারদের অঙ্ক বুঝে ইকবালের সমর্থনপুষ্ট তৃণমূলও কলেজে ছাত্র পরিষদের মনোনয়ন আটকানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সোমবার রাত থেকেই দু’পক্ষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। তাই মঙ্গলবার কলেজ নির্বাচনে মনোনয়ন পর্বে সদলবল হাজির হন মোক্তার ও ইকবাল দু’জনেই। কারণ এই কলেজের নির্বাচনের ফলাফলই হবে এলাকা দখলের সঙ্কেত। এ দিন দু’দলের সংঘর্ষ তারই পরিণাম। এবং ফের উত্তপ্ত বন্দর এলাকা। |