ক্ষোভ-বিক্ষোভ জমা হচ্ছিলই। বাহিনীর মনোবল কমছিল ক্রমশ। এ বার গার্ডেনরিচে যা ঘটে গেল, তাতে রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হতে পারে বলে পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের একাংশ মনে করছেন। এবং তাঁদের অনুমান, এর সূচনা হিসেবেই এ দিন দুপুরে সিএমআরআইয়ে নিহত এসআইয়ের মৃতদেহ দেখতে গিয়ে পুলিশকর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎকুমার পচনন্দাকে।
লালবাজার অবশ্য বিক্ষোভের কথা মানছে না। যদিও রাজভবন-সূত্রের খবর, একের পর এক ঘটনায় রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও, যিনি একদা ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। গার্ডেনরিচের ঘটনা প্রসঙ্গে এ দিন দিল্লিতে রাজ্যপাল বলেন, “যে কোনও রাজ্যেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা ফিরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।”
রাজভবনের খবর, কলকাতায় ফিরে নারায়ণন বিষয়টি নিয়ে মুখ্যসচিবের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। কলেজ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ দিন গার্ডেনরিচে পুলিশের সামনেই গুলি চলেছে। যে ব্যক্তি গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ, তাকে পুলিশ ঘটনার পরে ধরে ফেলেছিল। কিন্তু অভিযোগ, তৃণমূলের এক নেতা তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যপালের আশঙ্কার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের কথাতেও। তাঁদের মতে, পুলিশের কাজে ইদানীং যে ভাবে বাধাদান ও হস্তক্ষেপ চলছে, তাতে রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের উঁচু, নিচু, সব স্তরেই কমবেশি ক্ষোভ বাড়ছে। অনেকে মনে করছেন, শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করায় বাহিনীর মনোবল ভাঙার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। “মনে হচ্ছে, ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছি।” সখেদ মন্তব্য এক ওসি-র। |
সম্প্রতি বইমেলা থেকে ফেরার সময়ে নিজের গাড়ি আসতে দেরি করায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এক ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসারের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনাদের ধরে চাবকানো উচিত।” রাজ্য প্রশাসনের প্রধানের মুখে এ হেন মন্তব্য ঘিরে স্বভাবতই তোলপাড় হয়েছে। তার রেশ না-কাটতেই এ দিনের ঘটনা। যার প্রেক্ষিতে কলকাতা পুলিশের এসআই পদমর্যাদার এক অফিসারের আক্ষেপ, “আমাদের এক সহকর্মীর গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। যারা গুলি করল তাদের এক জনকে ধরে ফেলার পরেও আমাদের সিনিয়র অফিসারদের উপস্থিতিতে স্থানীয় কাউন্সিলর সদলে এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন! তার পরে সে কাউন্সিলরের সঙ্গে হেসে হেসে গল্পও করল। আমাদের কর্তারা দাঁড়িয়ে দেখলেন! এ সব কত দিন সহ্য করব?” ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার এক অফিসারের প্রশ্ন, “এক জন অফিসার গুলিতে মরার পরেও বাহিনীকে যদি নেতাদের কথা শুনে চলতে হয়, তা হলে আমাদের মনোবল কোথায় গিয়ে ঠেকবে? এর পরে কি মনোবল বলে আর কিছু থাকবে?”
এ দিন গুলি চলার আগে এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি হয়। তখন হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রাথমিক ভাবে লাঠিচার্জ ছাড়াও কাঁদানে গ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারত। অথচ পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়েইনি। কেন?
এক ইনস্পেক্টরের ব্যাখ্যা, “জনা পঞ্চাশের একটা পুলিশ টিম ঘটনাস্থলে ছিল। তার মধ্যে হেভি রেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড (এইচআরএফএস)-এর ১৬-১৭ জনের দলও ছিল। তাদের হাতেই ছিল টিয়ার গ্যাস গান ও পর্যাপ্ত শেল। কিন্তু তা ফাটানোর কোনও নির্দেশ কর্তারা দেননি।” ঘটনাস্থলে এক জন যুগ্ম কমিশনার ও এক জন ডেপুটি কমিশনার উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের একাংশের মতে, গার্ডেনরিচ-কাণ্ড আসলে বছরখানেক ধরে চলা বিভিন্ন ঘটনার পরিণতি। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, ২০১১-য় আসানসোল ও নদিয়ার বগুলায় দুর্গাপুজোর বিসর্জনকে কেন্দ্র করে গোলমাল থামাতে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। তার পরেই মহাকরণ থেকে জেলায় জেলায় নির্দেশ যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ যেন বন্দুক ব্যবহার না-করে। পুলিশের একাংশের মতে, নীচুতলায় মনোবল ভাঙার সেই শুরু। |
কবে |
কোথায় |
কী ঘটনা |
১৮ মার্চ ১৯৮৪ |
গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর |
ডিসি (বন্দর) বিনোদ মেটা ও দেহরক্ষীকে কুপিয়ে খুন |
২৭ ডিসেম্বর ২০০৫ |
টালিগঞ্জ |
জবরদখল তুলতে গিয়ে পাথরের ঘায়ে হত কনস্টেবল সামসুদ্দিন খান |
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ |
গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর |
গুলিতে মৃত্যু সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর |
|
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপের প্রথম অভিযোগ ওঠে ২০১১-য় জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জন নিয়ে অশান্তির ঘটনায়। রাস্তা জুড়ে উদ্দাম নৃত্য, শব্দবাজি পোড়ানো-সহ বিভিন্ন অভিযোগে ভবানীপুর থানার পুলিশ কয়েক জন যুবককে আটক করেছিল। ‘গোলমাল মেটানোর’ কথা বলে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ভবানীপুর থানায় হাজির হয়ে অভিযুক্তদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে।
এর পরের ঘটনা পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের জেরে গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেনের বদলি। উদাহরণ আরও আছে। মগরাহাটে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ কাটতে গিয়ে উন্মত্ত জনতার আক্রমণ থেকে বাঁচতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। তাতে দু’জন মারা যান। পুলিশের একাংশের অভিযোগ: এর পরেই মগরাহাট থানার অধিকাংশ অফিসারকে হয় বদলি, নয়তো ‘ক্লোজ’ করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। “সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলছে। পুলিশ কীসের ভরসায় এগোবে?” মন্তব্য এক অফিসারের। |