স্বামীর মৃত্যুর খবর তাঁর কাছে পৌঁছে দেননি পুলিশকর্তারা। টিভি দেখেই এক আত্মীয় ফোন করে ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর কাছে খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে টিভি চালাতেই চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে গেল মিনতি চৌধুরীর।
হরিদেবপুরের সারদাপল্লির একতলা বাড়িটি চার বছর আগে তৈরি করেছিলেন কলকাতা পুলিশের কর্মী তাপস চৌধুরী। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে তিনিই। স্ত্রী মিনতিদেবী, ১৯ বছরের মেয়ে তনুশ্রী এবং ১৫ বছরের ছেলে তমালকে নিয়ে ঠাকুরপুকুরের মাঝিপাড়ার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে উঠে এসেছিলেন তাপসবাবু। তনুশ্রী বিবেকানন্দ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তমাল বেহালার ম্যান্টনের আর্য বিদ্যামন্দিরের নবম শ্রেণির ছাত্র। মঙ্গলবার ঘটনার সময় তমাল স্কুলেই ছিল। আত্মীয়েরা তার জন্য অপেক্ষা না-করেই মিনতিদেবী আর তনুশ্রীকে নিয়ে রওনা হয়ে যান একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। মৃত্যুর পরে সেখানেই রাখা হয়েছে তাপসবাবুকে।
|
তার একটু পরেই হাসপাতালে পৌঁছে যান কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। হাসপাতালে পুলিশ অফিসারেরা মিনতিদেবীকে জানান, তাঁদের বাড়িতে খবর দিতে পাঠানো হয়েছে এক পুলিশকর্মীকে। পুলিশই হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে যায় মিনতিদেবীদের। চিকিৎসকেরা তাঁদের জানান, একটি গুলি তাপসবাবুর হৃৎপিণ্ডের তলায় বিঁধে গিয়েছে। এক্স-রে করে গুলিটির অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে তাপসবাবুর।
তাপসবাবুর ভাইপো সোমনাথ চৌধুরী জানান, টিভিতে খবর দেখেই তাঁরা জানতে পারেন, গার্ডেনরিচের ঘটনায় কাকা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ফোন করে কাকিমা মিনতিদেবীকে সব জানান তিনি। হাসপাতালে পৌঁছে স্বামীর মৃতদেহ দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন মিনতিদেবী। জ্ঞান হারান বেশ কয়েক বার। চিকিৎসকেরা তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। মেয়ে তনুশ্রীকে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ আলাদা ঘরে আত্মীয়দের সঙ্গে বসিয়ে রাখেন।
একে একে হাসপাতালে আসতে শুরু করেন তাপসবাবুর আত্মীয়েরা। আসেন পড়শিরাও। এক প্রতিবেশী বলেন, “বহু দিন ধরেই তাপসবাবুকে চিনি। আগে পাশের পাড়ায় থাকতেন। ভাল মানুষ ছিলেন। তাই খবর শুনে না-এসে পারলাম না।” তাপসবাবুর বৃদ্ধা মা অসুস্থ, শয্যাশায়ী। হরিদেবপুরেই তাপসবাবুর এক ভাইয়ের কাছে থাকেন তিনি। তাপসবাবু প্রতিদিনই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ওই বাড়িতে যেতেন।
এ দিন বেলা ৩টে নাগাদ খাকি-সাদা স্কুলের পোশাক পরা তমালকে নিয়ে হাসপাতালে ঢোকেন কয়েক জন আত্মীয়। বাবার মৃত্যুর খবর তখনও জানানো হয়নি তাকে। একসঙ্গে অনেক ক্যামেরার ঝলকানি দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে নিজেকে সামলাতে পারেনি সে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। আত্মীয় ও পড়শিদের অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। |
নিহত পুলিশকর্মীর মেয়ে তনুশ্রী ও স্ত্রী মিনতি চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র |
এর মধ্যেই তনুশ্রী প্রশ্ন তোলেন, “কলেজ নির্বাচনে আসা একটি ছেলের হাতে অস্ত্র এল কী করে? খুনিকে না-ধরলে বাবার দেহ নেব না।” পরে মন্ত্রী ও পুলিশ কমিশনার খুনিকে ধরার প্রতিশ্রুতি দেন বলে জানান তাপসবাবুর আত্মীয়রা। এর মধ্যে শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবু ঘোষণা করেন, তাপসবাবুর পরিবারের এক জনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। রাতে তনুশ্রী বলেন “একটা মানুষ চলে গেলেন! টাকা বা চাকরি দিয়ে সেই ক্ষতি কি পূরণ করা যায়?”
সহকর্মীরা জানান, ১৯৮২ সালে কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল-পদে যোগ দেন তাপসবাবু। প্রথম পোস্টিং ছিল লালবাজারে। ধাপে ধাপে তিনি সাব-ইনস্পেক্টরের পদে পৌঁছন। বিভিন্ন থানা হয়ে তিনি স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সদর দফতরে যোগ দেন। এক সহকর্মী জানান, সোমবার রাতেই তাপসবাবুকে বলা হয়, গার্ডেনরিচে ডিউটিতে যেতে হবে।
মিনতিদেবী জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীর ভাল নেই বলে জানিয়েছিলেন তাপসবাবু। কিন্তু পরে বলেন, কলেজের ভোটে গোলমাল হতে পারে। তাই এ দিন ছুটি নেওয়া ঠিক হবে না। পরে সুযোগমতো ছুটি নেবেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
মঙ্গলবার ডিউটি করলেন। সেই সঙ্গে তাঁর ছুটি হয়ে গেল চিরতরে। |