গার্ডেনরিচে কলেজ নির্বাচন ঘিরে অশান্তির জেরে দুষ্কৃতীর গুলিতে মৃত্যু হল কলকাতা পুলিসের এক সাব-ইনস্পেক্টরের। সাম্প্রতিক অনেক ঘটনার মতো এই ঘটনাতেও মুখ পুড়ল শাসক দলের।
গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে অশান্তির সূত্রপাত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলা নিয়ে বচসাকে ঘিরে। লড়াইটা ছিল মূলত ছাত্র পরিষদ এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মধ্যে। ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি টপকে পরে সেটাই হয়ে দাঁড়াল এলাকা দখলের সংঘর্ষ। কলেজ ছেড়ে রাস্তায় শুরু হল বোমা-গুলির যুদ্ধ। যার মধ্যে পড়ে মঙ্গলবার দুপুরে প্রাণ দিয়েছেন পুলিশকর্মী তাপস চৌধুরী (৫৬)। ঘটনার পরেই এলাকায় পৌঁছে পুরমন্ত্রী এবং স্থানীয় বিধায়ক ফিরহাদ হাকিম দাবি করেছিলেন, কংগ্রেস এবং সিপিএম-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা মিলে অশান্তি করছে। সিপিএম থেকে কংগ্রেসের আশ্রয়ে আসা মোক্তার নামে এক দুষ্কৃতীই গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
কিন্তু বেলা বাড়তেই শাসক শিবিরে অস্বস্তি বাড়ল। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়া দৃশ্যে দেখা যায়, গুলি চালাচ্ছে শেখ সুহান নামে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ এক জন। যার কাকা ইবনে বাতিকল এলাকায় দলের শাখা সম্পাদক পদে রয়েছেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। ছবিতেই ধরা পড়ে, ঘটনার কিছু ক্ষণ আগে সুহান দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় তৃণমূলের নেতা, ১৫ নম্বর বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার পাশে। ফিরহাদ যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনও তাঁর পাশেই ছিলেন মুন্না। ওই ছবি দেখে এ দিন সন্ধ্যায় খুনের অভিযোগে সুহান-সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গোলমাল বাধানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে আরও ৯ জন। |
বাবার মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছে ছেলে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
গার্ডেনরিচে গোলমালের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছিল সোমবার রাত থেকেই। সে দিন বোমা বানাতে গিয়ে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর (১৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) রঞ্জিত শীলের ছেলে অভিজিৎ গুরুতর আহত হন। কংগ্রেসের অভিযোগ, তাদের কোণঠাসা করার জন্যই হামলার ছক কষছিল তৃণমূল। এ দিন কংগ্রেস-সিপিএমের দিকে অভিযোগের তির ঘুরিয়ে দিয়ে ফিরহাদ বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করেন বলেও বিরোধীদের অভিযোগ। কিন্তু ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার পরে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বলতে হয়েছে, অভিযুক্ত সকলকেই গ্রেফতার করার
জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার দাবি, “টিভির ফুটেজ সব সময় সত্যি বলে না।”
দুষ্কৃতীদের হাতে পুলিশের মৃত্যু এবং অভিযুক্তরা তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ দু’দিক থেকেই এই ঘটনা মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর কাছে অস্বস্তির। এ দিন রাত পর্যন্ত গার্ডেনরিচের ঘটনা নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। তবে নন্দীগ্রামে সরকারি অনুষ্ঠানে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেন, “গণতন্ত্র মানে শান্তি। গণতন্ত্র মানে উন্নয়ন। গণতন্ত্র মানে পুলিশকে গুলি করে মেরে ফেলা নয়। গণতন্ত্র মানে জেলাশাসকের দফতরে গুন্ডামি নয়!” প্রশাসনিক মহলের ব্যাখ্যা, মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত ছিল গার্ডেনরিচে এ দিনের এবং বহরমপুরে জেলাশাসকের দফতরে ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরীর সমর্থকদের তাণ্ডবের ঘটনার দিকে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে গার্ডেনরিচের ঘটনার রিপোর্টও চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সুহান-সহ চার জনকে গ্রেফতারের খবর এ দিন সন্ধ্যায় মহাকরণে জানান স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তাপসবাবুর সহকর্মীদের অভিযোগ, ঘটনার পরেই তাঁরা লাল-কালো ডোরাকাটা জামা পরা, সুহানকে বন্দুক-সহ জাপটে ধরেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার মদতে জনতা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
পুলিশ-হত্যার ঘটনায় দলের নাম জড়িয়ে পড়ায় ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে আন্দাজ করেই তাপসবাবুর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টার কসুর করেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। মর্গে গিয়েছিলেন পার্থবাবু, ফিরহাদ, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ সুব্রত বক্সী প্রমুখ। শ্মশান পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের নেতারা। তাপসবাবুর মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন পার্থবাবু। |
যে ভাবে এ দিন তাপসবাবুর মৃত্যু হয়েছে, তাতে পুলিশের নিচু তলা ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগ, হরিমোহন কলেজের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের গোলমাল হতে পারে বলে আগাম খবর দিয়েছিল কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। তা সত্ত্বেও এ দিন সকালে এলাকায় ছিল না কোনও র্যাফ। যে সব পুলিশ কর্মী ছিলেন, তাঁদের হাতে ছিল স্রেফ লাঠি। এক বারের জন্যও দেখা যায়নি পুলিশের কোনও বড় কর্তাকে। এ সবের জেরে একবালপুরের যে হাসপাতালে তাপসবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দা।
পুলিশের একাংশের অভিযোগ, পর্যাপ্ত পুলিশ না-থাকায় সকাল থেকেই কলেজের সামনের এলাকার দখল নেয় সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। একটা সময় বৃষ্টির মতো বোমা পড়তে থাকে। লালবাজারে বারবার জানানো সত্ত্বেও পুলিশকর্তারা আসেননি। অভিযোগ, শাসক দলের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যবস্থা নিতে চাননি লালবাজারের কর্তারা।
পুলিশের নিচু তলায় ক্ষোভের খবর পৌঁছেছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও। পার্থবাবু, ফিরহাদ এবং শোভনবাবুকে তিনিই পাঠান হাসপাতালে। কিন্তু তাপসবাবুর পরিবার জানিয়ে দেয়, খুনি যুবককে ফের ধরা না-হলে তারা মৃতদেহ নেবে না। সরব হয় বিরোধী দলগুলিও। চাপের মুখে এ দিন আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি পুলিশ কমিশনার। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করেও জবাব পাওয়া যায়নি গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষের কাছেও।
পুলিশ সূত্রের খবর, বন্দর এলাকায় তৃণমূল এবং কংগ্রেস দু’পক্ষই যথেষ্ট শক্তিশালী। এলাকা কাদের কব্জায় থাকবে, তা নিয়ে দু’দলের নেতাদের মধ্যে বিরোধ চলছে। গত বার নির্বাচনে হরিমোহন ঘোষ কলেজে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট এসএফআই-কে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে। এ বার জোট ভেঙে গিয়েছে। নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে দু’দলের নেতারাই এই নির্বাচনকে বেছে নিয়েছিলেন।
স্থানীয় কংগ্রেস নেতা মোক্তার আহমেদ ও ১৫ নম্বর বরোর তৃণমূলের চেয়ারম্যান ইকবাল ওরফে মুন্নার দলবল ময়দানে নেমে পড়ে। তাঁদের দলবলই এ দিন এলাকায় তাণ্ডব চালায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ঘটনার সঙ্গে কংগ্রেসের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার নিরপেক্ষ ভাবে পুলিশকে দিয়ে কাজ করাতে পারছে না। ঘটনা ঘটার আগে যে ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, পুলিশ তা করতে পারছে না।” প্রয়োজনে এই ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবির পাশাপাশি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও প্রদীপবাবু জানিয়েছেন। আজ, রাজ্য জুড়ে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত পথ অবরোধের ডাক দিয়েছে ছাত্র পরিষদ। ফিরহাদ অভিযোগ করলেও ঘটনার সঙ্গে তাদের যোগ উড়িয়ে দিয়ে সিপিএম রাজ্য
সম্পাদক বিমান বসু বলেন,
“আমাদের নাম জড়ানো ভিত্তিহীন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদল বৈঠক ডাকুন মুখ্যমন্ত্রী।”
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবু অবশ্য কংগ্রেস এবং সিপিএমের দিকে রাজনৈতিক আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন। এ দিন সন্ধ্যায় তাপসবাবুর শেষকৃত্যে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “কংগ্রেস, সিপিএম ভেবে দেখুক সমাজবিরোধীদের হাতে দলীয় পতাকা গুঁজে দিয়ে এবং তাদের উস্কানি দিয়ে রাজ্যে শান্তি নষ্ট করার চেষ্টা কতটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারসম্মত?” |