দাদা, গাড়ি নিয়ে আর যাবেন না প্লিজ। বিপদ হতে পারে।
সাবধান করে দিয়েছিলেন স্থানীয় দোকানদার। তখনও বুঝতে পারিনি, কিছু ক্ষণের মধ্যে গুলি খেয়ে মরতে দেখব কাউকে। এটা জানতাম, ১৯৮৪ সালে ডিসি বন্দর বিনোদ মেটাকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল এই গার্ডেনরিচে। আর এ দিন সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীকে বেঘোরে মরতে দেখলাম নিজের চোখেই।
ডাকঘরের ঠিকানা জে ২০৬ ও ২০৮ এ, পাহাড়পুর রোড। হরিমোহন ঘোষ কলেজ। মঙ্গলবার ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র তোলার দিন। গত বার জিতেছিল তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট। এ বার
তারা বিবদমান।
|
লুটিয়ে পড়েছেন গুলিবিদ্ধ সাব ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী। মঙ্গলবার গার্ডেনরিচে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
সোমবার রাতেই কলেজের উল্টো দিকে একটি নির্মীয়মাণ বাড়িতে বোমা বাঁধতে গিয়ে জখম হয় স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জিত শীলের ছেলে অরিজিৎ শীল-সহ আরও দুই যুবক। এ দিন যে কিছু একটা ঘটতে পারে, সেই আশঙ্কায় সকাল থেকে কলেজের সামনে মোতায়েন ছিল প্রচুর পুলিশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছিল দু’দলের বচসা। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে দেখে সকাল ১১টার পর থেকে পাহাড়পুর রোডে বাস ও অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল। ছাড় ছিল শুধু সংবাদমাধ্যমের গাড়ির জন্য।
বাঁধাবটতলা মোড় পার করতেই চোখে পড়ল রাস্তার দু’ধারে কংগ্রেস ও সিপিএমের পতাকা। একটু তফাতে তৃণমূলের ঝান্ডা। কিছুটা এগোতে এক দোকানদার বলে উঠলেন, “দাদা, গাড়ি নিয়ে আর যাবেন না প্লিজ। বিপদ হতে পারে।” রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কয়েকটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের গাড়িও। সেখান থেকেই দেখলাম প্রায় কয়েক হাজার লোকের জটলা। হাতে লম্বা লাঠির ডগায় দলীয় পতাকা বাঁধা। পুলিশের সামনেই তৃণমূল ও কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা একে অপরের উদ্দেশে চোখ রাঙাচ্ছে। তাদের শান্ত করতে আতঙ্কিত মুখে ছুটে যাচ্ছেন পুলিশ কর্মীরা। কোনও পদস্থ কর্তাকে চোখে পড়ছে না গোটা তল্লাটে।
|
শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি |
কলেজের ভিতরে অবশ্য অশান্তি নেই। পরিচয়পত্র দেখে তবেই পড়ুয়াদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দরজার এ পারে তৃণমূল চিৎকার করে চলেছে, বহিরাগতদের নিয়ে কলেজ দখল করতে চাইছে কংগ্রেস। তাদের দোসর সিপিএম। কংগ্রেস গলা তুলে বলছে, তাদের ছাত্রদের মনোনয়নপত্র তুলতে দেবে না বলে গণ্ডগোল বাধাচ্ছে তৃণমূল। এ বার দু’পক্ষকে রাস্তার দু’দিকে সরিয়ে দিতে মাইকে প্রচার শুরু করল পুলিশ। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মুদিয়ালি রোডের দিকে আর কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের বাঁধাবটতলার দিকে সরিয়ে দিয়ে মাঝখানে প্রাচীর করে দাঁড়াল তারা। আমরা, সাংবাদিকরা তখন কলেজ গেটের উল্টো দিকে একটি বন্ধ দোকানের চাতালে জায়গা নিয়েছি।
বেলা পৌনে ১২টা। হঠাৎ মুদিয়ালি রোডের দিক থেকে কানে এল কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ। কিন্তু তৃণমূল কর্মীরাই দেখলাম খেপে গিয়ে বলতে লাগলেন, কংগ্রেস তাঁদের আক্রমণ করছে!
স্থানীয় তৃণমূল নেতা মহম্মদ একবাল ছুটে গিয়ে এক পুলিশ অফিসারকে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিলেন, “কংগ্রেসের মোক্তার গুলি চালাচ্ছে। আর আপনারা কিছু করবেন না?” একবালের সঙ্গ নিলেন আরও কয়েক জন। তাঁদের দেখে এ বার খেপে গেলেন কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরাও। প্রাচীর করে দাঁড়ানো পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে দু’পক্ষই তেড়ে গেল একে অপরের দিকে। দলীয় পতাকা খুলে নিয়ে সেই লাঠি দিয়ে শুরু হল মারামারি। গোটা এলাকাটা তখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
|
অন্ত্যেষ্টির পথে। —নিজস্ব চিত্র |
আচমকা বাঁধাবটতলার শৈলশ্রী সিনেমা হলের দিক থেকে শুরু হল বৃষ্টির মতো বোমাবাজি। নিমেষে ধোঁয়ায় ঢেকে গেল রাস্তাঘাট। তারই মধ্যে কানে আসতে লাগল গুলির শব্দ। কোন দিক থেকে গুলি আসছে, বোমাই বা ছুড়ছে কোন পক্ষ, কিছুই বোঝার উপায় নেই। আতঙ্কে ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছেন দোকানিরা। বহুতলের দরজা-জানালা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রাণভয়ে দৌড়তে শুরু করেছি আমরাও। তারই মধ্যে খুব কাছ থেকে গুলি চালানোর একটা শব্দ কানে এল! চোখ ফেরাতেই ধোঁয়ার মধ্যে দেখি, বুকে হাত চেপে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন সাদা উর্দি পরা কলকাতা পুলিশের এক কর্মী। এক বার উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তার পর সেই যে লুটিয়ে পড়লেন, আর উঠলেন না। সাদা জামাটা রক্তে লাল হয়ে গেল।
তখনও জানি না, মানুষটির নাম তাপস চৌধুরী (৫৬)। স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব-ইনস্পেক্টর। বাঁধাবটতলার দিকে গণ্ডগোলকারীদের সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন। আচমকাই খুব কাছ থেকে গুলিটা লাগল তাঁর। আর ঠিক তখনই একটা বোমাও পড়ল খুব কাছে। দৌড়ে এলেন কয়েক জন কনস্টেবল ও স্থানীয় মহিলা। ওর মধ্যেই পুলিশের ভ্যানে চাপিয়ে তাপসবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
|
লাল জামা পরা এই সেইশেখ সুহান। —নিজস্ব চিত্র |
পথের লড়াই অবশ্য থামেনি। এক সাংবাদিকের পায়ের কাছেই এসে পড়ল একটি বোমা। কোন গলিতে ঢুকলে প্রাণে বাঁচা যাবে? উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কারণ, প্রায় প্রতিটি গলিতেই তখন আশ্রয়কারীরা প্রস্তুত হচ্ছে পাল্টা হামলার জন্য! ততক্ষণে অবশ্য ঘটনাস্থলে এসে গিয়েছে আরও পুলিশ এবং র্যাফ। এসেছেন বড় কর্তারা।
ক্রমে কমে আসতে লাগল বোমা-গুলির শব্দ। পরিষ্কার হতে লাগল ধোঁয়ার চাদর। ঘটনাস্থলে এলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে বলে গেলেন, “মোক্তার কংগ্রেসে যোগ দিয়ে সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই গণ্ডগোল করেছে!”
রাস্তার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তখন টহল দিচ্ছে র্যাফ। আর ধুলোর মধ্যে ক্রমশ ফিকে হচ্ছে মাটিতে লেগে থাকা রক্তের দাগ। |