রাত পোহালেই প্রেমের দিন। চারদিকে প্রেমের রমরমা। কিন্তু এত প্রেমের মধ্যে
প্রেমপত্ররা কি গা-ঢাকা দিয়েছে আজকাল? তারই খোঁজ নিলেন অদিতি ঘোষ
টেবিলের উপর একগাদা কাগজ ছড়ানো। তার মধ্যে মুখ গুঁজে এক মনে লিখেই চলেছে কমলিকা। আজ অভ্রর জন্মদিন। তাই নিজের হাতে লেখা প্রেমপত্র দিয়ে বার্থডে উইশ করবে ওকে। প্রথমটা লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিল। দ্বিতীয়টারও একই পরিণতি। তার পরের চিঠিটা খানিকটা লেখার পরেই একরাশ বিরক্তি মুখে নিয়ে উঠে পড়ল। তার পর মোবাইলটা হাতে নিয়ে চটপট একটা এসএমএস টাইপ করে ফেলল, ‘হ্যাপি বার্থডে জানু। লাভ ইউ সো মাচ। বিকেল ৫টা, মানি স্কোয়ার।’ জেনারেশন ওয়াই এ ভাবেই প্রেম করতে স্বচ্ছন্দ।
চিঠির মাধ্যমে মনের কথা জানানো চলে আসছে বহু দিন ধরেই। কিন্তু এই ২০১৩ তে দাঁড়িয়ে কেমন আছে চিঠিপত্ররা? প্রেম তো চিরকালীন। কিন্তু প্রেমপত্রও কি লেখা হয় এখনও? কী বলছে নতুন প্রজন্ম?
আশুতোষ কলেজের ছাত্র দীপনের মতে এ যুগে প্রেমপত্র বড়ই অচল। যেখানে একটা এসএমএস-এই কাজ হয়ে যায় সেখানে এত ঝঞ্ঝাটে যেতে নারাজ তিনি। স্পষ্ট বললেন, “ও সব এখন অবসলিট হয়ে গিয়েছে। ফোন যখন রয়েছে তখন চিঠির কী প্রয়োজন! আর কোনও সময় যদি ফোন না করা যায় তো মেল বা বিবিএম তো রয়েছেই।”
সত্যিই তো, এ যুগে সবার হাতে সময় বড্ড কম। তার মধ্যে আর মনের কথা কাগজে ফুটিয়ে তোলা হয় কই? আর কেনই বা লিখবেন! যখন প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে পৌঁছে যাওয়া এখন মুহূর্তের ব্যাপার।
তবে কি সত্যিই প্রেমপত্র জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের বা গল্প-উপন্যাসের পাতায়? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অভিনন্দার গলায় কিন্তু অন্য সুর। “কে বলল আমাদের প্রজন্ম প্রেমপত্র লেখে না? ক্লাস নাইনে পড়ার সময় প্রথম বয়ফ্রেন্ড। কোচিং ক্লাসে নোটের ভিতর দিয়ে কত চিঠি হাতবদল হয়েছে,” হাসতে হাসতেই বললেন তিনি। সেই বয়ফ্রেন্ড আজ আর তাঁর জীবনে নেই। কিন্তু চিঠিগুলো রয়ে গিয়েছে আজও। কেন? জিজ্ঞেস করাতে বললেন, “কত কী লিখতাম তখন। নিজে এত বদলে গিয়েছি ভাবলেও অবাক লাগে!”চিঠি তো স্মৃতি ধরে রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।
তবে বর্তমানে চিঠি কি শুধুই ছোটবেলার খুচরো প্রেমে আটকে গিয়েছে? হাতে যোগাযোগের অন্যান্য উপায় না থাকলে বিকল্প হয়ে ওঠে চিঠি!
যাদবপুরের দীপান্বিতার মতে, “তা নয়। আসলে মনের কথা সব সময় মুখে প্রকাশ করা যায় না। সে ক্ষেত্রে তা লিখে ফেলাই ভাল। তবে কাগজ-কলমেই লিখতে হবে তার কোনও মানে নেই। আমি বিয়ের প্রোপোজাল পেয়েছিলাম ই-মেলে। তখনকার প্রেমিক, বর্তমান স্বামী রঙ্গনের কাছ থেকে পাওয়া সেই মেলটি আজও সযত্নে সেভ করা আছে।”
সত্যিই তো! বিবর্তন তো অমোঘ সত্য। সেই সত্যির উপর ভিত্তি করে চিঠিরও বিবর্তন ঘটেছে। কাগজের জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে ই-মেল বা চ্যাট। ক্ষতি কী তাতে! প্রেম রয়েছে প্রেমের জায়গায়। শুধু ‘পত্র’ নিজের রূপ বদলে নিয়েছে খানিকটা।
তবে কিছু সময় পিছিয়ে গেলে চিঠির অন্য রূপ খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই। যে সময়ে পয়লা বৈশাখ আর বিজয়া জানাতে ব্যবহার করতে হত কাগজ-কলম তখন মানুষের কাছে প্রেম জানানোর অন্যতম উপায় ছিল সাদা কাগজে কালো অক্ষরে লেখা মনের কথা। কেমন ছিল সে সব সময়?
ব্যাঙ্কের কর্মী মধ্যবয়সি দীপঙ্করবাবু বললেন,“বিয়ের আগে টানা তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করেছি স্ত্রীর সঙ্গে। তবে দেখা-সাক্ষাৎ করার সে রকম সুযোগ ছিল না। যাতায়াতের রাস্তায় কিংবা কলেজের বাইরে দেখা হত এক ঝলক। বাকি কাজটা করত চিঠি। এখনও দু’জনের লেখা গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠি রয়ে গেছে। কখনও পড়লে মনে হয় একসঙ্গে কতগুলো দিন পেরিয়ে এলাম দু’জনে!” প্রায় আশি ছুঁইছুঁই কসবার অরুণা বসুর কাছে তাঁর স্বামীর লেখা পুরোনো চিঠিগুলো আজ নিঃসঙ্গতা কাটানোর অন্যতম উপায়। চাকরি সূত্রে স্বামী বাইরে থাকার সুবাদে চিঠি লেখালিখি হত বিস্তর। অরুণার মতে, “প্রেমপত্র হয়তো নয়। নিতান্তই সাংসারিক কথাবার্তা। কিন্তু আজ ওর অবর্তমানে চিঠিগুলো পড়লে মনে হয় যেন পাশেই আছে ও।”
মিমি চক্রবর্তী
অভিজিৎ বর্মন (পটা)
ছোটবেলায় ভি ডে-তে স্কুলের ডেস্কে অনেক
প্রেমপত্র পেয়েছি। কিন্তু লিখিনি একটাও
নীরার স্রষ্টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের তাঁর স্ত্রী স্বাতীকে লেখা চিঠিতে কবি সুনীলের বাইরে এক স্বামী/বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সব চিঠিপত্রও তো তাঁর বাকি সৃষ্টির মতো অমূল্যই থেকে যাবে।
বর্তমান প্রজন্ম কি তবে হারাচ্ছে কিছু? এক টুকরো কাগজ যে ভাবে স্মৃতি ধরে রাখতে পারে তা কি সম্ভব নিত্যনতুন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রে! চার বছরের প্রেমের পর শ্রুতি ও শুভম সদ্য বিবাহিত। শ্রুতি জানালেন, “শুভমের লেখা কিছু প্রেমপত্র আছে আমার কাছে। চিঠির মজা হল ওটা ওর নিজের হাতের লেখা। মেল বা এসএমএস-এ তো আর সেই সুযোগ নেই। এক বার তো চিঠি পড়তে গিয়ে হাতের লেখা বুঝতে না পেরে শেষমেশ বাধ্য হয়ে ফোন করেই জিজ্ঞেস করতে হল কী লিখেছে! সে নিয়ে তো আজও হাসাহাসি হয়।”
অর্থাৎ ই-মেল, স্কাইপ বা চ্যাটের প্রবল চাপেও কাগুজে প্রেমপত্র হারিয়ে যায়নি পুরোপুরি। খানিক নিষ্প্রভ হলেও অস্তিত্ব সে আজও টিকিয়ে রেখেছে।
কাল ভ্যালেনটাইন’স ডে। তার পরেই আবার বাঙালির নিজস্ব প্রেমের উৎসব সরস্বতী পুজো। কী ভাবছেন? সেন্ট ভ্যালেনটাইনের সম্মানে আর মা সরস্বতীর আশীর্বাদ নিয়ে লিখে ফেলবেন না কি দু’কলম নিজের মনের মানুষটিকে? কে বলতে পারে সেই চিঠিই হয়তো আপনাদের প্রেমের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে আজীবন। এ ভাবেই বেঁচে থাকুক প্রেমপত্র। না হয় খানিক বিবর্তিত রূপেই।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.