প্রথমে এক প্রৌঢ়া মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দেওয়া হল। তারপরে সেই মহিলার কিশোরী মেয়ের ঘাড়েও চাপিয়ে দেওয়া হল একই অপবাদ। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ওই কিশোরী তখন পুলিশে অভিযোগ করেন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ২৯ জানুয়ারি সেই কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। সে কথাও পুলিশকে জানান হয়। এরপরেই গত ২ ফেব্রুয়ারি মালদহের হবিবপুরের বাসিন্দা ওই আদিবাসী প্রৌঢ়ার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে লুঠপাট করা হয়েছে। ওই মহিলার বক্তব্য, “সবটাই করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে। আসলে আমাদের ৬ বিঘা জমি রয়েছে। সেইটা হাতিয়ে নিতেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।”
পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ৬ স্থানীয় বাসিন্দা মালদহ আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। মালদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ বলেন, “দু’টি মামলায় অভিযুক্ত ছয় জন আজকে আদালতে আত্মসর্মপণ করেছেন। জমি জায়গা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে ওই আদিবাসী পরিবারের বিবাদ চলছিল। ফের যাতে ওই পরিবারের উপর কেউ হামলা না করতে পারে সেদিকে পুলিশ নজর রেখেছে।”
ওই প্রৌঢ়ার অভিযোগের তির স্থানীয় কিছু সিপিএম কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে। তবে সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেন, “ওই পরিবারের উপরে যাঁরা হামলা করেছে, তাদের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই।” হবিবপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের ধীরেন্দ্রনাথ মুরারিও দাবি, তিনি ওই পরিবারকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, ওই পরিবারের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তবে পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেছেন, “সরকার মহিলাদের উপর অত্যাচার বন্ধে বদ্ধপরিকর। ওই অদিবাসী পরিবারের উপর কেউ যাতে হামলা করতে না পারে তা দেখব।” রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রও পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
মালদহ থেকে বুলবুলচন্ডী,
সেখান থেকে কিছুটা পাকা রাস্তা পরিয়ে লালা মোরামের পথ। দু’কিলোমিটার সেই পথ পেরিয়ে ওই প্রৌঢ়ার বাড়ি। তাঁদের তিন মেয়ে। বড় কাঞ্চনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট সুশীলা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেজ মেয়ে হবিবপুর সামু হেমব্রম হাইস্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। বুধবার দুপুরে নিজের ঘরে বসে কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, “দিনের পর দিন নির্যাতন করছে। পুলিশ কিছু করেনি। ভীষণ ভয়ে রয়েছি।”
এই এলাকায় ডাইনি অপবাদ কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বহু দিনের। ১৯৯৬ সালে ডাইনি অপবাদে হবিবপুর লাগোয়া ব্লক সুকানদিঘি এলাকায় একই পরিবারের ৭ জনকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। ২০১০ সালে হবিবপুর, গাজোল, পুরাতন মালদহ এবং বামুনগোলা এলাকায় ডাইনি সংক্রান্ত ১৮টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। ২০১১ সালে সেই অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২।
হবিবপুরের বিধায়ক সিপিএমের খগেন মুর্মু জানান, আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় চিকিৎসার পরিকাঠামো এখনও প্রায় কিছুই নেই। শিক্ষা পরিকাঠামোও দুর্বল। কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও সরকার উদাসীন। তাঁর কথায়, “কাউকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে দিলে সে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সেই সুযোগে তার জমি অন্যেরা ভোগদখল করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রেও তেমনই কোনও ইন্ধন রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি।” |