রাজ্য সরকারের টানাটানির সংসার। তারই মাঝে চলেছে ক্লাবকে অনুদান কিংবা মেলা-উৎসবের মতো পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে দেদার খরচ। আবার উন্নয়ন খাতে যেটুকু খরচ হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তারও বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কোচবিহার বিমানবন্দরের পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প।
যাত্রী না-পাওয়ায় যেখানে নিয়মিত ছোট বিমানই চালানো যায়নি, সেই কোচবিহার বিমানবন্দরে বড় বিমান (৪২ আসনের এটিআর) চলাচলের জন্য রানওয়ে তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে রাজ্য দেবে সাড়ে ১৭ কোটি।
কিন্তু ঘটনা হল, কোচবিহার ও আশপাশে নতুন কোনও শিল্পসংস্থা বিনিয়োগ করছে, এমনটা শোনা যায়নি। সেখানে বড় কোনও শিল্পতালুক গড়ার পরিকল্পনা এই মুহূর্তে রাজ্যেরও নেই। অথচ আর্থিক কর্মকাণ্ড না-বাড়লে নিয়মিত বিমানযাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বস্তুত যাত্রীর অভাবে বছরখানেক আগে কোচবিহারে ছোট বিমান চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ হেন পরিস্থিতিতে কোচবিহার থেকে বড় বিমান চালাতে বিমানসংস্থাগুলি কতটা আগ্রহী, সে ব্যাপারে শিল্প-বণিকমহলের বড় অংশ সন্দিহান। তাদের অভিযোগ, প্রকল্পের বাস্তবতা যাচাই না-করেই সরকার রানওয়ের পিছনে লগ্নির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারের কী বক্তব্য? মহাকরণের অফিসারদের ব্যাখ্যা, “পরিকাঠামো তৈরি হলেই বিমানসংস্থা উৎসাহী হবে।”
বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলছে। কোচবিহার থেকে বড় (এটিআর) বিমান চালানোয় উৎসাহ দেখাচ্ছে না কোনও বিমানসংস্থা। এয়ার ইন্ডিয়া-র সহযোগী অ্যালায়ান্সের এটিআর বিমান রয়েছে। জেট-এরও রয়েছে। দু’টি সংস্থাই জানিয়ে দিয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে কোচবিহার থেকে এটিআর চালানোর পরিকল্পনা তাদের নেই।
কোচবিহার থেকে বিমান চালাতে গেলে বিমানসংস্থার অন্যতম ভরসা হবে যারা, সেই বণিক সভাগুলোও প্রকল্পের আর্থিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিশেষ আশাবাদী নয়। তাদের দাবি, বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোট বিমানের উড়ান নিয়মিত চালানোর ব্যবস্থা আগে হোক। কোচবিহার জেলার বণিকসভার সম্পাদক রাজেন বৈদ্য, উত্তরবঙ্গের ফেডারেশন অফ চেম্বার অফ কমার্স-এর সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস দু’জনের গলাতেই এক সুর। “নিয়মিত ছোট বিমানই চালানো হোক না! কোচবিহারের মানুষ আগে নিয়মিত বিমান পরিষেবার সুযোগটা পান! তার পরে না হয় বড় বিমানের কথা ভাবা যাবে।” বলছেন ওঁরা।
কোচবিহারে বড় বিমানের রানওয়ের জন্য সাড়ে পঁচিশ কোটি টাকা বরাদ্দের যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের ডিরেক্টর জেনারেল প্রিয়দর্শন রায়ও। তাঁর কথায়, “এ তো সাধারণ জ্ঞানের বিষয়! যেখানে ছোট বিমানে যাত্রী হয়নি, সেখানে বড় বিমান চালিয়ে লাভ হবে না।” যদি ভবিষ্যতের কথা ভেবে রানওয়ে বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে এলাকায় নতুন শিল্প না-হলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎও অন্ধকার বলে মনে করেছেন তিনি।
মহাকরণের খবর: কোচবিহার বিমানবন্দরে রানওয়ের সামনে রয়েছে মরা তোর্সা নদী। তার উপরে বক্স-কালভার্ট বানাতে হবে। সেই কালভার্টের উপর দিয়ে রানওয়ে প্রায় চারশো মিটার সম্প্রসারিত হবে। মোট প্রকল্প-ব্যয়ের ৭০%, অর্থাৎ সাড়ে ১৭ কোটি টাকা দেবে রাজ্য, বাকিটা জোগাবে যোজনা কমিশন। কোচবিহারের রানওয়ের দৈর্ঘ্য এখন অন্তত হাজার মিটার। সেখানে অনায়াসে ১৮ আসনের ছোট বিমান নামতে পারে। তেমনই এক বিমান নিয়ে ২০১১-র জুলাইয়ে কলকাতা-কোচবিহার রুটে উড়ান শুরু করেছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের বিমানসংস্থা নর্থ-ইস্ট শাটল। তাদের শর্ত ছিল, প্রতি উড়ানে অর্ধেক আসনের ভাড়া রাজ্য সরকার দেবে। সেই ভর্তুকি পেয়েও তারা লাভ করতে পারেনি, কারণ বাকি অর্ধেক আসন ভর্তি করার জন্যও পর্যাপ্ত যাত্রী হয়নি। শেষমেশ তিন মাসের মধ্যে সাকুল্যে ন’দিন উড়ান চালিয়ে নর্থ-ইস্ট শাটল কোচবিহার থেকে পাততাড়ি গোটায়।
তার পরে আর কোনও সংস্থা কোচবিহারে বিমান চালানোর প্রস্তাব দেয়নি। উড়ানহীন বিমানবন্দর রক্ষণাবেক্ষণে এবং কর্মী-অফিসারদের বেতন দিতে গিয়ে ফি মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৪০-৪৫ লক্ষ টাকা। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের রিজিওন্যাল এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর মনোহরলাল লাকড়া বলেন, “রানওয়ে বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকার সম্প্রতি আমাদের থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছিল। আমরা দিয়েছি।”
মহাকরণ-সূত্রের খবর: ফাইলটি আপাতত অর্থ দফতরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং যে হেতু প্রকল্পটি নিয়ে উদ্যোগী (কলকাতা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের উদ্বোধনের দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি তা বলেও দিয়েছেন), তাই টাকা মঞ্জুর হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে মহাকরণ-সূত্রে মন্তব্য করা হয়েছে। |