|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
কোন পাপে, কার অভিশাপে |
কুমার রাণা |
স্মৃতিরা বেড়াতে গেছে। তাদের খালি ঘরে ইঁদুরের অখণ্ড স্বাধিকার। স্মৃতিগুলো বড় ভুলোমনা; যাওয়ার আগে রান্নাঘরেই ফেলে গেছে ডিমের খোসা, উচ্ছিষ্ট ওদন। পচন দুর্গন্ধে আমোদিত কীটদল। রাজ্য-জোড়া তীব্রগতি স্খলনে পতনে আর্তনাদ— উন্মাদ! উন্মাদ! রাজধানীতে প্রতিধ্বনি, ‘য়্হ অওরত পাগল হ্যায়!’ কান্যকুব্জ থেকে কন্যাকুমারী, হা-হা হি-হি ছি-ছিক্কার। প্রত্যহ প্রভাতী ধিক্কার ও বিলাপসিক্ত বিবৃতি: এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার! তার কপালে আলো ফেলতে, চাঁদমামার টিপ দিতে, অতএব, রাহুমুক্তির প্রতীক্ষা; হাতে মালা চন্দন এবং মোবাইল ফোন। শাসক-বদলের ধ্রুপদী প্রার্থনা।
স্মৃতিরা বেড়াতে গেছে। তারা জানে, আকাশের তারারাও জানে, অন্ধকার রাহুর কারণে নয়। বহু-বহুকাল চেরাগগুলোতে তেল নেই, অথচ আলো নেভার দায় চাপে হাওয়ার ঘাড়ে।
স্মৃতি ঘরে এসো। বাবু-ছাপ বঙ্গীয় কপালে একটু ভাঁজ ফেলো— পাগলের সঙ্গে পৃথিবীটা ভাগ করে নেওয়ার জন্য কারা এবং কেন বা উন্মুখ? রাস্তায়, দোকানে, ক্লাসঘরে, লালবাড়ির কামরায় যেখানে মন্ত্রী সাজানো থাকে, অথবা অন্যত্র দফতরে1 উন্মাদেরও বাড়া বাক্যক্ষেপ; প্রতি বাক্যে যোনি, লিঙ্গ, বিকৃত-বীভৎস রমন-ধর্ষণ যেন যতিচিহ্ন। অন্তরাত্মা অভিশপ্ত, বুদ্ধির কোমরে বাত। কেন? সবই কি, ‘কী হইতে কী হইয়া গেল?’ না কি, বিছিয়ে রাখা পথ ধরে তার আগমন?
‘মানুষের স্মৃতিও তরল’— ঠিক কথা; কিন্তু, স্মৃতি কেন তারল্যের বশ? একটু স্মরণে আনো অভিশাপের জন্মকথা। অন্তত তুমি তো জানো, অকস্মাৎ নয়, এরও একটা ইতিহাস আছে— ভদ্রতায় ঢাকা। এখন উদরাময়; ত্রস্ত-ব্যস্ত কাপড়চোপড়ে দাগ। অ্যাঃ, ছ্যা ছ্যা, ভদ্রতার জাত মান সব গেল। |
|
অনুযোগ, দলতন্ত্রের বিরোধিতা থেকে যে-দল শাসক, তারা ঘোরতর কোনও এক তন্ত্রের সাধক— এক ব্যক্তি, এক দল; একই ছবির বারংবার নিলাম। এবং, যে ঘরগুলোতে উনুনে আগুন নেই, গোটা সূর্যটা পেটের ভেতর আগুন জ্বালে, সে ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয় তাদেরই পাড়ার কেউ— যারা অন্য দলে। সব কি হঠাৎ, একান্ত নিষ্কারণ?
ইতিহাস প্রকৃত নিষ্ঠুর, সে শোনায় চার দশক আগের দুটো পঙক্তি:
‘আত্মঘাতী ফাঁস থেকে শব খুলে এনে প্রশ্ন করো তুমি কোন্
দল
রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসার আগে প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল’
(শঙ্খ ঘোষ, ‘তুমি কোন দলে’)
সুশীল সমাজের কাছ থেকে দলতন্ত্র নাম পেল এই তো সে দিন। আর, পঙ্ক্তিগুলো যখন লেখা, তখনও ‘চিহ্নিত’ দলতন্ত্রীরা ক্ষমতা থেকে বছর সাতেক দূরে। কিন্তু, কবির কথা কে শোনে? তাঁরা তো স্বপ্নের মাতাল! আমরা সব বাস্তবের আড়কাঠি, বর্তমানের ঝকঝকে ফড়িয়া। আমরা ভুলে যেতে চাই, আমাদের রক্তের কণায় মিশে আছে দলের বিরাট রূপ, দলীয় ক্ষুদ্রতা।
রাজনীতি তো সর্বদোষে দোষী, কিন্তু সমাজ? সে বড় জীবাণুমুক্ত? নিষ্পাপের পরাকাষ্ঠা? রাজ্যবাসীর ভাগ্যভাগের ঝুঁটি যাঁর হাতে, সমাজটাকে তিনিই ভাল চেনেন। জানেন বলেই অনুশীলনে আয়ত্ত তাঁর কর্মধারা, বাক্য-স্ফূর্তি— বাবু-বিবিদের কাছে যেটা নিছক পাগলামি।
বিলাপ নান্দনিক, কিন্তু যথেষ্ট কি? যে স্খলন পতন নিয়ে হাহাকার, তাকে আটকানোর হকও আছে, দায়ও আছে, কিন্তু তাকত আছে কি? সেটা তো কবে যেন লুঠ হয়ে গেছে, অথবা ছিল কি কখনও? পথজোড়া লোলুপ আঁধার; প্রদ্যোত অপুষ্টি-মৃত, পথ খোঁজার দায় নেই। অতএব মড়াকান্না: হবে না, হবে না, কিস্যু হবে না।
কেন এমন হল? লোককথার কেতাব ঘাঁটো; দুর্দশা, দুর্গতিকে দুর্ভাগ্য ও পাপের ফল বলে সান্ত্বনা পেয়ে বেঁচে থেকেছে লোক। কিন্তু বাবু-বঙ্গ এক আশ্চর্য অলোক— তাই তার এমন কোনও লোককথাও
নেই। সুতরাং, একটা কমিটি গড়া যাক; একটা লোককথার নির্মাণ হোক, কোন পাপে, কার অভিশাপে এই পরিণতি অথবা পরিণতিহীনতা। তার আগে স্মৃতিগুলোর বাড়ি
ফেরা দরকার। স্মৃতির ঘরে, ভাঙা ডিমের খোসায় ইঁদুরের কদমবুশি বন্ধ হওয়া দরকার। |
|
|
|
|
|