ভোট-রাজনীতির বর্তমানকে
ছোটাচ্ছে সন্ত্রাসের অতীত
তীত না বর্তমান, বারেবারেই গুলিয়ে যাচ্ছে!
সম্বুলক্ষ্মী কলইয়ের কাছে বর্তমান। টাকারজলা বাজারের কাছে তাঁর চিলতে ঘরের উঠোনে বসে ১২ বছর আগের সন্ধ্যা স্পষ্ট দেখতে পান প্রৌঢ়া। বাড়িতে ঢুকে উগ্রপন্থীরা খুন করে গিয়েছিল ব্লক উপদেষ্টা কমিটির (পঞ্চায়েত বা স্বশাসিত উন্নয়ন পরিষদের সদস্যেরা এই কমিটি নির্বাচন করেন) চেয়ারম্যান সম্পত সিংহ কলইকে। আহত হয়েছিলেন স্ত্রী সম্বুলক্ষ্মীও। এত দিন পরেও ককবরক ভাষায় বুঝিয়ে দেন, সময় যেন থমকেই আছে তাঁর উঠোনে।
সম্বুলক্ষ্মীরই এলাকার তরুণ সুধীর দেববর্মার কাছে অতীত। সুধীরের বাবা উদয় দেববর্মাও ছিলেন ব্লক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। পরিষ্কার বাংলাতেই সুধীর বলছেন, “সম্পত খুন হওয়ার পরে বাবা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। উগ্রপন্থীরা টাকা চাইল, সিপিএম পার্টি ছেড়ে দিতে বলল। জম্বুইজলায় রাস্তা আটকে মেরে দিল। দু’টো খুন কুড়ি দিনের মধ্যে। তবে এখন আর ভয় পাই না।”
রমেন্দ্র দেববর্মা
সম্বুলক্ষ্মী কলই
প্রবীণেরা ভুলতে চান। পারেন না। নবীনেরা অতীত ভুলে বর্তমানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। আর এই মানিয়ে নিতে পারা-না পারার দ্বন্দ্বই ত্রিপুরার এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে শাসক বামেদের বিরাট হাতিয়ার। অতীতের সন্ত্রাসের দুঃস্বপ্ন যেন ফিরে না-আসে, এটা নিশ্চিত করতেই বামেদের জেতাতে হবে নিয়ম করে বলছে সিপিএম। ঠিক যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সিপিএম গত বিধানসভার ভোটে বলত এবং এখনও বলে, তৃণমূলের হাত ধরে সাতের দশকের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জমানার ‘কালো দিন’ ফিরে আসবে। নির্বাচনী ইস্তাহারে ত্রিপুরা বামফ্রন্ট সব চেয়ে বেশি শব্দ ব্যয় করেছে সন্ত্রাসবাদ এবং তার মোকাবিলায় সাফল্য বোঝাতে। সঙ্গে দু’টো আস্ত পুস্তিকাও বার করেছে সিপিএম মানুষের মনে ভয়ের স্মৃতি উস্কে তাঁদের নিজেদের দিকে রেখে দেওয়ার জন্য। একটি বই ‘ত্রিপুরায় বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসবাদীদের জন্মদাতা কারা? মদতদাতা কারা? আক্রান্ত কারা?’ অন্যটি ‘সেই দিন, সেই রাত’। রাজ্যে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত কংগ্রেস এবং তৎকালীন টিইউজেএস জোট সরকারের ‘সন্ত্রাসে’র সাল-তারিখ ধরে খতিয়ান রয়েছে এতে।
যা অতীত, কেন এত বেশি করে টেনে আনতে হচ্ছে তাকে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকার বলছেন, “এই কারণে যে, নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে এরা তো সেই দিনগুলি দেখেনি। এদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। জেনারেশন গ্যাপ হয়ে গিয়েছে। মানুষকে সতর্ক করছি যে, এই শক্তিটা শেষ হয়ে যায়নি।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এদের (উগ্রপন্থী) ঘাঁটি আছে, সংখ্যায় কমেছে। নিশ্চেষ্ট নয়। কংগ্রেস নানা ভাবে এদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। পুলিশের তথ্য দিয়েই বলছি। শুধু ত্রিপুরা নয়, এরা আবার মাথাচাড়া দিলে গোটা দেশের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।” কিন্তু মাথাচাড়া দেবে কেন? মানিকবাবুর মতে, “ঘোলা জলের মাছ শিকারিরা স্বচ্ছ জল দেখলে ভয় পেয়ে যায়!”
উপজাতি সংরক্ষিত গোলাঘাটি কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কেশব দেববর্মারও একই যুক্তি, “অতীতকে বাদ দিয়ে তো বর্তমান নয়! বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারায় জাতি-উপজাতির মধ্যে বিভেদ ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল এখানে। শান্তি যা এসেছে, সেটা রক্ষা করা না গেলে উন্নয়ন হবে না।” শিনাই-গাবর্দি লোকাল কমিটির যে কার্যালয়ে বসে কেশব কথা বলছিলেন, দশ বছর আগে সেটাই ছিল এক বাঙালি ব্যবসায়ীর বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। বাঙালি-উপজাতি বিরোধের সময় এলাকা ছেড়েছেন দোকান-মালিক। রাজ্যের নানা জেলায় উপজাতি-অধ্যুষিত বহু এলাকাতেই বাঙালিরা আর স্থায়ী আস্তানা গড়তে ফেরেননি। জীবিকার জন্য যাঁরা আসেন, কাজ সেরে ফিরে যান। সিপিএমের হিসাবে উপজাতি-বাঙালি সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৮০০, ঘরছাড়া হয়েছেন হাজার চারেক মানুষ। এবং সিপিএমের দাবি, উন্নয়ন দিয়ে উপজাতি-মন জয় করে সন্ত্রাস ঠেকানোয় ত্রিপুরা সারা দেশের কাছে ‘মডেল’। উপজাতি এলাকার জন্য স্বশাসিত উন্নয়ন পরিষদের সদস্য এবং সিপিএমের লোকাল কমিটি সম্পাদক সন্তোষ দেববর্মার বক্তব্য, “এই সব অঞ্চলে বাজার শেড, মেয়েদের স্কুল, কমিউনিটি হল, মোটর স্ট্যান্ড, সেতু, রাস্তা হয়েছে। উপজাতি মানুষ বুঝেছেন, শান্তি আর উন্নয়ন একটাকে ছাড়া অন্যটা হয় না!” ব্লক উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান রমেন্দ্র দেববর্মা তথ্য দিচ্ছেন, ২০০৮ সালে সিপিএমের ত্রিপুরা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের সদস্যসংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬৮ হাজার। এখন ২ লক্ষ ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। উপজাতিরা যে তাঁদের বিশ্বাস করছেন, এই তথ্যই তার ইঙ্গিত বলে রমেন্দ্রর দাবি।
পুরনো টিইউজেএস এখন আইএনপিটি। এখনও কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে। এবং তাদেরও দাবি, উপজাতিরা এ বার সিপিএমের সঙ্গ ছেড়ে তাদের দিকে আসবেন। কিন্তু তাদের দিকেই তো সন্ত্রাসের যাবতীয় অভিযোগের আঙুল। অভিযোগ, আইএনপিটি-র সভাপতি (দলের একমাত্র বিধায়কও) বিজয় রাঙ্খলই সন্ত্রাসের হোতা! আইএনটিপি-র সাধারণ সম্পাদক এবং মান্দাইয়ের দলীয় প্রার্থী জগদীশ দেববর্মা পাল্টা বলছেন, “সভাপতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। সিপিএমের আমলে এত সন্ত্রাস, তারা আবার অন্যদের কী বলে? কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়তে নেই, কথাতেই আছে না?” কংগ্রেসের ইস্তাহারও সন্ত্রাস-প্রশ্নে বিশেষ ঢোকেনি! আলোচনার পথে সন্ত্রাসবাদ সমস্যার মীমাংসা হবে, এই একটা উল্লেখ শুধু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সুদীপ রায় বর্মণের মতে, টানা কুড়ি বছরের বাম জমানায় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সিপিএম ‘গোয়েবলসীয় কায়দা’য় কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বিগত কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারের নীতি নিয়েছে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.