|
|
|
|
প্রণবের সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা |
সংস্কারে আরও গতি চায় কেন্দ্র |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
দু’টি বাড়িই রাইসিনা হিলসে। ভৌগোলিক দূরত্ব ঢিল ছোড়া। কিন্তু আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি ভবনের সঙ্গে নর্থ ব্লকের দূরত্ব কয়েক যোজন।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে দেওয়া বক্তৃতায় প্রণব মুখোপাধ্যায় আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক হয়ে চলার কথা বলেছেন। অর্থ মন্ত্রকে তাঁর উত্তরসূরি কিন্তু চাইছেন সংস্কারে আরও গতি আনতে। বাজেট অধিবেশনে একই সঙ্গে পেনশন ও বিমা বিল পাশ করাতে চান পি চিদম্বরম। খুচরো ব্যবসা, বিমানের পর এ বার এই দু’টি ক্ষেত্রেও আরও বিদেশ বিনিয়োগ টানতে চাইছেন তিনি।
প্রণববাবু অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বরাবরই সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক পদক্ষেপ করেছে অর্থ মন্ত্রক। এখন যখন তিনি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে, তখনও কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেব দেশের স্বার্থে মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাজার-নির্ভর অর্থনীতি সম্পর্কে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। এই সতর্কবার্তার পরেও কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি পেনশন ও বিমা ক্ষেত্রে ৪৯% প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে তৎপর।
সিঙ্গাপুর, হংকং, ফ্র্যাঙ্কফুর্ট ও লন্ডন। এই চার শহরে গিয়ে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এ জন্য বৈঠকও সেরে এসেছেন চিদম্বরম। বিদেশি ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থাগুলির কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, পেনশন ও বিমা ক্ষেত্রের দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। আসুন। ভারতে বিনিয়োগ করুন। শুকনো আমন্ত্রণ নয়। বিল দু’টি পাশ করাতে তিনি যে বিরোধী দলগুলির সঙ্গেও নিঃশব্দে কথা চালাচ্ছেন, জানিয়েছেন তা-ও। বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির মাত্রা ২৬% থেকে বাড়িয়ে ৪৯% করার বিলে গত অক্টোবরেই সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পেনশন ক্ষেত্রে এই প্রথম বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খোলা হবে।
কিন্তু সংসদে এখন যা সমীকরণ, তাতে বিজেপির সমর্থন ছাড়া বিল দু’টি পাশ করানো কঠিন। বামেরা তো বটেই, বেশ কিছু আঞ্চলিক দলও এর বিরোধিতা করবে। এক সময়ের শরিক তৃণমূল যার অন্যতম। ফলে সংসদের দুই কক্ষে বিল পাশ করাতে গেলে, বিশেষ করে রাজ্যসভায়, বিজেপির সমর্থন প্রয়োজন। সরকারের পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যা ছিল না বলেই গত শীতকালীন অধিবেশনে বিমা বিল নিয়ে এগোয়নি কেন্দ্র। সরকারি সূত্রের খবর, গত ক’মাস ধরে অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, যশবন্ত সিনহাদের সঙ্গে কথা বলেছেন চিদম্বরম। নীতিগত সমর্থনের আশ্বাসও আদায় করেছেন। পাশাপাশি, সংসদে সংখ্যা জোগাড় করতে সক্রিয় সংসদীয় বিষয়ের মন্ত্রী কমলনাথও। প্রণববাবুর পরে দলের নতুন রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসেবে তিনিই এখন কংগ্রেস সভানত্রী সনিয়া গাঁধীর বিশেষ ভরসার পাত্র। আর এই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই এশিয়া-ইউরোপের বিনিয়োগকারীদের অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছেন চিদম্বরম।
কিন্তু বিজেপিকে কী ভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করছে সরকার? অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, বিজেপি বরাবরই বলে এসেছে, নীতিগত ভাবে তারা পেনশন বা বিমা ক্ষেত্রে সংস্কারের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু তাদের দাবি ছিল, শ্রমিকস্বার্থকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া যাবে না। তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চয় যে নয়ছয় হবে না, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। পেনশন তহবিল থেকে ন্যূনতম সুদ-বাবদ আয়ও সুনিশ্চিত করতে হবে। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, চিদম্বরম তিনটি দাবিই মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজেপিকে।
সমস্যা আছে বিমা বিল নিয়ে। বিজেপি-নেতা যশবন্ত সিনহার নেতৃত্বাধীন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ ছিল, বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৬% করা হোক। কমিটির বাকি সব সুপারিশ মোটের উপর মেনে নিলেও এই ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা ৪৯% করতে চাইছে অর্থ মন্ত্রক। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সতর্ক করেছেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা বাদ দিয়ে বহু ধনী রাষ্ট্র সংস্কার করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে। ভারতের এই ফাঁদ এড়িয়ে চলা উচিত। ইউপিএ-১ জমানায় বামেরাও এর বিরোধিতা করেছিল। বামেরা এ-ও দাবি করেন যে, তাদের বিরোধিতাতেই দেশের অর্থনীতির দরজা বন্ধ থাকার ফলেই ২০০৮ সালের বিশ্বজনীন মন্দার ধাক্কা ভারতকে বেসামাল করতে পারেনি।
প্রণব-হীন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী চান সংস্কার। বাম-তৃণমূল ও অন্য আঞ্চলিক দলের আপত্তি উড়িয়ে চিদম্বরম সংস্কারের রথ ছোটাতে তৎপর। কাজটা সহজ হবে বিজেপিকে পাশে পেলে। চিদম্বরম বিজেপি নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এত দিন সংস্কার থমকে থাকায় আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থাগুলি ভারতে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েছে। তা বিদেশি লগ্নির আসার পথে বাধা হয়ে উঠছে। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তাই বিদেশি বিনিয়োগের টোটকা ছাড়া গতি নেই। তাই লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো প্রয়োজন। আপাতত তাই পূর্বসূরির সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করেই ঝুঁকি নিতে চান চিদম্বরম। |
|
|
|
|
|