|
|
|
|
রাহুল-দুর্গে উন্নয়নের বাঁশিওয়ালা মোদী |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
রাহুল গাঁধীর মঞ্চে নরেন্দ্র মোদীর প্রবেশ।
রাজধানীর বুকে কলেজের ছেলেমেয়েদের মাঝে গুজরাতের বিকাশ-পুরুষ! দেশের যে যুব সম্প্রদায়কে নিজের দিকে টানতে তৎপর হয়েছেন রাহুল, খোদ দিল্লিতে সেই যুবসমাজের মন জয় করে গেলেন মোদী! শ্রীরাম কলেজের প্রাঙ্গণে মোদীকে ঘিরে হাজারো ‘গুগল গুরুর শিষ্যের’ উচ্ছ্বাস তো অন্তত তেমন বার্তাই দিচ্ছে।
গুজরাতে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার মুহূর্ত থেকেই মোদী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এ বার তাঁর নিশানা দিল্লি। সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন, “গুজরাতের জয় গোটা ভারতের জয়!” সুকৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, গুজরাতের সাফল্যকে পুঁজি করেই দিল্লি দখলের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। সেই স্বপ্নটাই আজ রাজধানীতে এসে ছাত্রছাত্রীদের কাছে ফেরি করে গেলেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে দলের যত অস্বস্তিই থাক।
আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পা রেখে গুজরাতের বঞ্চনা নিয়ে সরব হওয়ার পরই দুপুরে মোদী ছুটে গেলেন শ্রীরাম কলেজে। তুলে ধরলেন গুজরাত মডেলের সাফল্য কাহিনি। উন্নয়ন আর সুশাসন। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, দেশের ৬৫ শতাংশ নাগরিকের বয়স ৩৫ বছরের নীচে। ফলে এখনও কলেজের গণ্ডি না-পেরোনো নতুন প্রজন্মকে কাছে টানার এই চেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ বইকি।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাস। তার মধ্যেই শ্রীরাম কলেজ। অরুণ জেটলি থেকে বিজয় গোয়েল, অনেকেই এই কলেজের প্রাক্তনী। জেটলির দৌত্যেই নরেন্দ্র মোদী আজ প্রথম পা রাখলেন কলেজ-পাড়ায়। এ দিনের বক্তা হতে মোদীকে জিতে আসতে হয়েছে একটা নির্বাচন! কার কথা শুনতে চান ছাত্রছাত্রীরা? ভোট নেওয়া হয়েছিল কলেজে। অন্তত পাঁচ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ধরাশায়ী করে, মায় রাহুল গাঁধীকেও পিছনে ফেলে এক নম্বর ‘চয়েস’ হয়ে ওঠেন
মোদী। সামান্য ভোট কম পেয়ে দ্বিতীয় রতন টাটা। |
|
পড়ুয়াদের উদ্দেশে। বুধবার শ্রীরাম কলেজে। ছবি: পিটিআই |
ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক চারটে। মোদী এলেন। কলেজের স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রায় দু’ মিনিট ধরে হাজার দুয়েক ছাত্রছাত্রীর করতালি। বাইরে বাম দলের ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদ। আর, হলের ভিতরে মোদী স্বপ্নের সওদাগর।
সামনে রাখা গ্লাস থেকে একটু জল খেয়ে নিলেন। তার পর গ্লাসটি নিজেই হাতে করে নিয়ে গেলেন মাইকের সামনে। সচরাচর নেতাদের নিরাপত্তা কর্মীরাই এই কাজটি করেন। মোদী নিজে কেন করলেন? উত্তর পাওয়া গেল কিছু ক্ষণ পরেই। বললেন, “নিরাশাবাদীরা বলেন, গ্লাস অর্ধেক খালি। আশাবাদীরা বলেন, গ্লাস অর্ধেক ভর্তি। আমি আরও আশাবাদী। আমি বলি, গ্লাস পুরোটাই ভর্তি। অর্ধেক জলে, অর্ধেক হাওয়ায়।”
বক্তৃতা লিখে আনেননি। কিন্তু এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যা বললেন, তা যেন নিখুঁত চিত্রনাট্য। বলার কথা ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সময় বেশি লাগছে দেখে প্রিন্সিপাল পি সি জৈনকে বললেন, “সময় আছে তো আমার?” হাততালি আরও এক বার। মজা করে মোদী বললেন, “শিক্ষক মহাশয়রা যা বলবেন, তা-ই শিরোধার্য।” প্রিন্সিপালের সম্মতি জানানো ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল? মোদী তাতেও থামলেন না। এ বার তরুণদের জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা যা বলবেন, সেটাই শেষ কথা। শুনতে চান তো আমাকে?” মন্ত্রমুগ্ধ পড়ুয়ারা সোল্লাসে বুঝিয়ে দিলেন মনের কথা।
মোদী কথা বলছিলেন গল্পের ছলে। যে ভাষা বোঝে তরুণ মন, সেই ভাষায়। বললেন চা তো খান! জানবেন সেই দুধ আসে গুজরাত থেকে। বিদেশে গেলে টমেটো-ঢ্যাঁড়স দেখলে বুঝবেন, সেটি গুজরাতের। যে মেট্রো নিয়ে গর্ব করে দিল্লি, তার কোচও আসে গুজরাত থেকে। আর
দেশের কোনও লোক নেই, যিনি গুজরাতের নুন খাননি। পর্যটন এক সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এখন
ঘরে ঘরে অমিতাভ বচ্চন বলছেন, এক বার তো ঘুরে যাও গুজরাতে। আপনারাও আসুন!
সরাসরি রাজনীতির কচকচিতে গেলেনই না মোদী। তবে ছুঁয়ে গেলেন কমনওয়েলথের দুর্নীতি আর গণধর্ষণের ঘটনার প্রসঙ্গ। আর পরোক্ষে রাহুলকে বিঁধে বললেন, “তরুণ প্রজন্মকে
অন্য দল ‘নিউ এজ ভোটার’ ভাবলে অবস্থা বদলাবে না।” বুঝিয়ে
দিলেন, তাঁর কাছে তরুণদের গুরুত্ব কতখানি। “আমি বলি, এরা ‘নিউ এজ পাওয়ার’। এঁরা সব ‘গুগল গুরু’র শিষ্য। ‘মাউস চারমার’ হয়ে গোটা দুনিয়া জয় করছেন।”
উন্নয়নের বাঁশিওয়ালা নিজেও তত ক্ষণে জয় করে ফেলেছেন ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়! তাঁর কথায় ফিরে ফিরে আসছিল ‘ব্র্যান্ড’, ‘প্যাকেজিং’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ। এখানে মোদীর নিজের ‘প্যাকেজিং’টি তবে কী? রাজনাথ সিংহ সভাপতি হওয়ার পর মোদী যখন দিল্লি এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, সেই সময়ই পরিকল্পনাটা ছকা হয়। সেটা হল, মোদীকে এখনই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হোক বা না হোক, মোদী দিল্লির বুকে নিজের ‘ব্র্যান্ডিং’ করার কাজটি শুরু করে দেবেন!
বিজেপি সূত্রের দাবি, নেহরুর পর অটলবিহারী বাজপেয়ীই একমাত্র যিনি ধর্মনিরপেক্ষ সুশাসন দিতে সক্ষম হয়েছেন। একদা হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ মোদী এখন ‘বাজপেয়ী’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সে কারণে
তিনি আজ হিন্দুত্ব নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, “চিরাচরিত ভাবে বিজেপিতে দু’টি মুখ থেকেছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষতার, একটি হিন্দুত্বের। এই দু’টি বিপরীত মুখের সমাগমেই বরাবর হেঁটেছে বিজেপি।” বাজপেয়ী ছিলেন উদার ধর্মনিরপেক্ষ মুখ, হিন্দু হৃদয়-সম্রাট ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। জিন্না-বিতর্কের সময় আডবাণী বাজপেয়ী হতে চেয়েছিলেন। পারেননি। এখন বিজেপিতে রাজনাথ সিংহরা হিন্দুত্বের মুখ হতে চাইছেন, মোদী উন্নয়নের মুখ হচ্ছেন। |
• নিরাশাবাদীরা বলেন অর্ধেক গ্লাস খালি। আশাবাদীরা বলেন, অর্ধেক ভর্তি। আমি আরও আশাবাদী। আমি বলি, গোটা গ্লাসই ভর্তি। অর্ধেক জলে, অর্ধেক হাওয়ায়।
• তরুণ প্রজন্মকে অন্য দল ‘নিউ এজ ভোটার’ ভাবলে অবস্থা বদলাবে না। আমি বলি, এঁরা ‘নিউ এজ পাওয়ার’। এঁরা ‘গুগল গুরু’র শিষ্য। ‘মাউস চার্মার’ হয়ে দুনিয়া জয় করছেন।
• আমার মডেল ‘পিটু-জিটু’। প্রো-পিপল, প্রো গভর্নেন্স। গোটা বিশ্ব ভারতকে বাজার হিসাবে ভাবে। আমি চাই, গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে যাক ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ব্র্যান্ড। |
|
মোদী-ঘনিষ্ঠ নেতাদের আশা, দল বা সঙ্ঘের যে নেতারা এখনও তাঁকে তুলে ধরার ব্যাপারে আপত্তি করছেন, মোদী-ঝড়ের সামনে তাঁরা সকলেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন। যে নীতীশ কুমার জোট ছাড়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তিনিও সাত-পাঁচ ভাবতে শুরু করেছেন। মোদী-ঘনিষ্ঠদের দাবি, লোকসভা জিততে হলে মোদীই বিজেপির তাস। এক বার বিজেপি ভাল ফল করলে শরিকরা জোটে যোগ দেবে। অতীতে এই ভাবেই মমতা-নবীন-চন্দ্রবাবু-ফারুকরা বিজেপির সঙ্গে এসেছেন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, এই খেলাতে একটু ঝুঁকিও রয়েছে। অতীতে এক দিকে স্বদেশি আর অন্য দিকে আর্থিক সংস্কারে মজতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছে বিজেপি। এ বারেও রাজনাথ উগ্র হিন্দুত্বের অবস্থান নিচ্ছেন, আর মোদীর বাজপেয়ী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। কতটা সফল হবে সেটা? সংশয়ে গেরুয়া শিবিরও। কারণ, বাজপেয়ীর পিছনে গোধরার কলঙ্ক ছিল না। নতুন প্রজন্ম কি রাহুলকে ছেড়ে মজবেন মোদীর স্বপ্নে?
শ্রীরাম কলেজ অবশ্য রাহুল আর মোদীর মধ্যে মোদীকেই বাছল। বিষয়টা অবশ্যই অস্বস্তিকর কংগ্রেসের কাছে। মণীশ তিওয়ারি তাই কটাক্ষ করে বলছেন, “উন্নয়নের ফানুসে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন মোদী। গোধরা নিয়ে একটি কথাও বলছেন না। মোদী ভুলে গিয়েছেন, আর্থিক বৃদ্ধি ও বিদেশি লগ্নির নিরিখে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যেও নেই গুজরাত।” মোদী যদি বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হন, তাহলে কংগ্রেসের আখেরে ভাল হবে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতাদের একাংশ। কারণ তা হলে সংখ্যালঘু ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে যাবে বলে তাঁদের আশা। আর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানোর কৃতিত্বও মোদীকে দিতে চান না তাঁরা। মনীশ এ দিন তাই বললেন, “মোদী যে একুশ শতকের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সে তো রাজীব গাঁধীর স্বপ্ন।” |
|
|
|
|
|