|
|
|
|
পাথর খাদানে অঙ্কুরেই শেষ বিকল্প রুজি |
ভাস্করজ্যোতি মজুমদার • মহম্মদবাজার |
পাথর শিল্পের বদলে বিকল্প রুজি দিতে বীরভূমের পাঁচামিতে পরিত্যক্ত খাদানে মাছ চাষ শুরু করিয়েছিল প্রশাসন। শুয়োর পালনও করানো হয়। কিন্তু আপাতত সব শিকেয়।
বহু সময়েই সরকারি প্রকল্পে লক্ষ-লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু সেই প্রকল্প সাধারণ মানুষের ঠিক কতটা উপকারে এল বা আদৌ এল কিনা বহু ক্ষেত্রেই তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ঠিক এমনটাই ঘটেছে মহম্মদবাজারের পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চল এলাকায়।
পরিত্যক্ত খাদান এলাকায় শুরু হওয়া মাছ চাষ ও শুয়োর পালনের প্রকল্পটি এখন বিশ বাঁও জলে। অধিকাংশ খামারেই বহু দিন আগে সব শুয়োর মারা গিয়েছে। মাছ ধরে বিক্রি করা বা নতুন মাছের চারা ছাড়া নিয়ে সরকারের কাছ থেকে নির্দেশ বা পরামর্শ না পেয়ে হতাশ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরাও। ফলে এলাকার মানুষকে বিকল্প কাজে টেনে এনে সরকার তাঁদের উপার্জনের যে নতুন পথ তৈরি করতে চেয়েছিল, তা হয়নি। অনেকেই ওই প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে ফের যুক্ত হয়েছেন দূষণযুক্ত পাথর খাদানের দিনমজুরিতেই। |
|
সাহেববাঁধের একটি পরিত্যক্ত খাদানের জলাশয়। ছবি: অনির্বাণ সেন। |
আদিবাসী গাঁওতা-র নেতা সুনীল সোরেন ও সম্পাদক রবিন সোরেনের অভিযোগ, “আমাদের আন্দোলন ঠেকাতেই এলাকাবাসীকে টোপ দিয়ে রাজ্য সরকার ওই প্রকল্প শুরু করেছিল। কিন্তু এক বছর পরে ওই প্রকল্পের কী হল, সে বিষয়ে আর কোনও খোঁজ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।” পাঁচামি নিয়ে রাজ্য সরকারের দিক থেকে গঠনমূলক ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে বলে তাঁদের দাবি।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯-’১০ সালে পাথর শিল্পের দূষণ রোধে এবং বেআইনি পাথর শিল্প বন্ধের দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু করে আদিবাসী গাঁওতা। তার জেরে বন্ধ হয়ে যায় এলাকার সমস্ত পাথর খাদান ও ক্রাশার। কর্মহীন হয়ে পড়েন হাজার-হাজার শ্রমজীবী মানুষ। নড়েচড়ে বসে স্থানীয় থেকে জেলা প্রশাসন, এমনকী রাজ্য সরকারও। গাঁওতার সঙ্গে স্থানীয় স্তর থেকে মহাকরণ পর্যন্ত আলোচনা গড়ালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়নি।
শেষে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে মহম্মদবাজারে এসে গাঁওতা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, খাদান ও ক্রাশার চালানোর ক্ষেত্রে যাঁরা নিয়মনীতি মানবেন তাঁদেরই অনুমতি দেওয়া হবে। পাশাপাশি বিকল্প রুজির ব্যবস্থা হিসাবে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে তৎকালীন রাজ্য সরকার। সেই প্রকল্পগুলির অন্যতম ছিল পরিত্যক্ত খাদানে মাছ চাষ ও শুয়োর পালন। এর কয়েক মাস বাদেই রাজ্যে সরকার পাল্টায়। তার পরে প্রায় দু’বছর হতে চলল। কিন্তু প্রকল্পগুলির রূপায়ণের হাল নিয়ে সরকারি মহলে আর উচ্চবাচ্য করা হয়নি বলেই অভিযোগ। প্রকল্পে যুক্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি থেকে আদিবাসী গাঁওতা সকলেই একই অভিযোগ করছেন।
অথচ মাত্র ২০১০ সালের ২২ ডিসেম্বরেই পাঁচামির দেওয়ানগঞ্জের সারদা খাদানে (পরিত্যক্ত) মাছের চারা ছেড়ে প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ। পাঁচামি এলাকার বারোটি পরিত্যক্ত খাদানের জলে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই খাদানগুলির দায়িত্ব দেওয়া হয় এলাকার বারোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে। প্রতিটি খাদানের জন্য ২৫/১৫ ফুটের চারটি করে খাঁচা অর্থাৎ বারোটি খাদানের জন্য মোট ৪৮টি খাঁচায় মাছ ছাড়া হয় (জলাশয় অনুযায়ী খাঁচাগুলি ছোট ও বড় করা হয়)। জেলা মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি খাঁচায় রুই, কাতলা, মৃগেল-সহ আরও কয়েকটি প্রজাতির প্রায় ৩,২০০টি করে মাছ ছাড়া হয়। এ ছাড়াও প্রতিটি খাদানে খাঁচা ছাড়াও আরও ১২ হাজার করে মাছ ছাড়া হয়েছিল। খাদান পিছু একটি করে বোট, দু’টি করে জাল ও মাছের খাবার দেওয়া হয়।
ওই বারোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীরই দাবি, মাছ চাষের পর কয়েক মাস মাত্র খোঁজখবর রেখেছিল মৎস্য দফতর। কিন্তু গত এক বছর ধরে মৎস্য দফতর প্রকল্প নিয়ে কোনও গা করছে না বলেই অভিযোগ। আদিবাসী গাঁওতার নেত্রী তথা ওই প্রকল্পে মাছ চাষ করা একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী বুধনি টুডুর অভিজ্ঞতা, “সরকার বিকল্প রোজগারের পথ হিসাবে মাছ ও শুয়োর চাষের ব্যবস্থা করেছিল ঠিকই। কিন্তু মাছ কী ভাবে ধরা ও বিক্রি করা হবে তা নিয়ে আমাদের কিছুই বলা হয়নি। ফলে মাছ এখনও জলেই রয়ে গিয়েছে।” মাস চারেক আগে দু’ একটি খাদানে জাল ফেলে দেখা হয়েছিল, এক-একটি মাছ দেড়-দু’কেজি এমনকী আড়াই কেজি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নির্দেশ না থাকায় ওই মাছ বিক্রি করার বিষয়ে এগোতে পারছেন না তাঁরা। দেওয়ানগঞ্জের আরও একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী মনিকা টুডু বলেন, “যদি প্রতি বছর মাছ ধরে মাছ বিক্রি করে ফের মাছ ছাড়া হয়, তা হলেই আমাদের কিছুটা অভাব ঘোচে। কিন্তু সরকারিবাবুরা মাছ বিক্রি বা নতুন মাছ ছাড়ার ব্যাপারে কিছু বলছেন না। ফলে আমাদের অভাব থেকেই গিয়েছে।”
একই অভিজ্ঞতা শুয়োর পালনে যুক্ত মহিলাদেরও। সনোদি কিস্কুু ও সোনামণি হেমব্রম দু’জনেই সরকারের থেকে সাহায্য পেয়ে শুয়োর পালন শুরু করেছিলেন। কিন্তু সঠিক পরামর্শ ও চিকিৎসার অভাবে তাঁদের সব শুয়োরই মারা পড়েছে। ফলে নতুন কাজে রুজির সন্ধানে আসা ওই দুই আদিবাসীই ফিরে গিয়েছেন খাদানে। সেখানে দিনমজুরি করেই তাঁদের সংসার চলছে। তাঁদেরও অভিযোগ, “ধুমধাম করে প্রকল্প শুরু হলেও পরে আর কেউ খোঁজ নেয়নি। কোনও কাজে প্রথম নেমে যদি সঠিক দিশা না-ই পাই, কী করে চলে বলুন?”
প্রকল্প নিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন জেলা মৎস্য আধিকারিক সৌরীন্দ্রনাথ জানা, তাতেই স্পষ্ট প্রকল্পের দুরবস্থা। সৌরীন্দ্রবাবু বলেন, “প্রায় ৪৩ লক্ষ টাকার ওই প্রকল্পে বারোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে দেওয়া এগারোটি করে শুয়োরের মধ্যে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই মরে গিয়েছে। মাছ ছাড়ার মাস তিনেকের মধ্যেই কয়েকটি জায়গায় খাঁচা ভেঙে মাছ চুরি হয়েছে। যত দিন গিয়েছে ভাঙা খাঁচার সংখ্যা ও মাছ চুরি দুই-ই বেড়েছে।” ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ওই এলাকায় প্রহরী রাখার জন্য আবেদন করলেও তা মঞ্জুর হয়নি বলেই তাঁর দাবি।
এক বছরেই প্রকল্পের এমন হাল কেন? সৌরীন্দ্রবাবু বলেন, “যেহেতু প্রকল্পটি এক বছরের ছিল, তাই এক বছরের জন্যই মাছের ও শূকরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।” তাঁর দাবি, “স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে বুঝিয়েই বলা হয়েছিল, এক বছর পর থেকে ওই জলাশয় ও খামারগুলির পুরো দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।” যদিও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ, বারবার যোগাযোগ সত্ত্বেও দফতর স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। জেলা মৎস্য আধিকারিকের মত, “হয়ত কোথাও বোঝার ভুল ছিল। সে কারণেই তাঁরা মাছ ধরেননি, বিক্রি করেননি বা নতুন মাছ ছাড়েননি। এ ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাবতীয় পরামর্শ দেওয়া হবে।” বোলপুরের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহেরও আশ্বাস, “আদিবাসী স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব।” |
|
|
|
|
|