|
|
|
|
দেবব্রতের ক্ষমাপ্রার্থনা |
কুকথার স্রোত বিরামহীন, প্রশ্নে রাজনৈতিক সৌজন্য |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কথার বিরাম নেই। থামছে না কুকথার স্রোতও! শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা লাগাতার কুবাক্য বর্ষণ করছেন। মাঝে মধ্যেই পাল্টা আসছে বিরোধী বাম শিবির থেকে! ধারাবাহিক এই কটু বাক্যের জেরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও থামছে না।
দলমত নির্বিশেষে রাজনীতির কারবারিরা যেন অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শুভেন্দু অধিকারীদের সঙ্গে তাল ঠুকছেন অধ্যাপক সৌগত রায়! সিপিএমের নেতাদের ‘হেরো মাল’ বলে তিনি সম্বোধন করছেন প্রকাশ্য সভায়! বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস তৃণমূলকে অভিযুক্ত করছেন ‘রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তি’র দোষে! প্রবল বিতর্ক এবং ধিক্কারের মুখে ক্ষমাপ্রার্থনা করে দেবব্রতবাবু পাপস্খালন করার চেষ্টা করছেন তো নতুন উদ্যমে দেখা দিচ্ছেন মন্ত্রী মদন মিত্র। বলছেন, “গোখরো, কেউটে নিয়ে শোব! তবু সিপিএম-কে নিয়ে শোব না!” থানার ওসি-কে প্রকাশ্য সভা থেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘কানের গোড়ায় এমন দেব যে, সকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না’! মদনেরই দলের সাংসদ শুভেন্দু আবার নেতাই বা নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ টেনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ‘গুন্ডা’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন!
কেন এত দ্রুত নামছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান? বাম ও অ-বাম, দুই শিবিরের রাজনীতিকদেরই একটি বড় অংশের মতে, প্রচারের আলো কেড়ে নেওয়ার অদম্য তাড়নাই প্রায়শ অসংযত মন্তব্য করতে প্ররোচনার কাজ করছে। একাংশ আবার মনে করছেন, দলের নিচু তলার কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতেই মাঠে-ময়দানে বেহিসাবি ভাষার প্রয়োগ চলছে। সংবাদমাধ্যম যতই হইচই করুক, এক শ্রেণির মানুষের মনঃপূত হচ্ছে বলেই কথায় লাগাম পরানো হচ্ছে না।
বামফ্রন্টের এক বিধায়কের কথায়, “বক্তৃতা করতে উঠলেই বেশির ভাগ নেতার মাথায় কাজ করছে, কী করলে খবরের শিরোনামে আসা যাবে! তার থেকেই মন্তব্য শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছে।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মতে, “রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নেতা-নেত্রীদের কথা এবং আচরণে প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সার্বিক অসহিষ্ণুতা থেকেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। দলে এই জন্যই আমরা বারবার বলছি, অন্য দিকে যে যা-ই বলুক, আমাদের কেউ যেন কথায় সংযম না-হারান।” একই ভাবে শিল্পমন্ত্রী তথা শাসক তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “অশালীন শব্দপ্রয়োগের রাজনীতি বন্ধ হোক। দলীয় কর্মীদের প্রতি আবেদন, বিরোধী পক্ষ ও সংবাদমাধ্যমের অপপ্রচারে প্ররোচিত হবেন না। সংযত ও সহিষ্ণু হয়ে মানুষের পাশে থাকুন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, “ভাষা সংযমহীনতা আজকের রাজনীতিতে বড় সঙ্কট তৈরি করেছে। দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি করে আসা আমরা কেন সংযত হচ্ছি না? আমরাই যদি সংযত না-হই, তা হলে মানুষের কাছে সংযত থাকার প্রত্যাশা করব কী করে?” |
সৌগত রায়, তৃণমূল
সিপিএম মায়ের ভোগে গিয়েছে।
চট করে বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা
নেই। হেরো মালদের দিয়ে
সভা করাবেন না।
|
দেবব্রত বিশ্বাস, ফব
তৃণমূল আর কত দিন রাজনৈতিক
বেশ্যাবৃত্তি করবে? বিজেপি-র
সঙ্গে শুয়েছ,...কংগ্রেসের
সঙ্গেও ঘর করেছ।
|
মদন মিত্র, তৃণমূল
বেলঘরিয়ার আইসি-কে
বলেছিলাম, কানের গোড়ায়
এমন দেব যে, সকালে আর
খুঁজে পাওয়া যাবে না।
|
|
ঘটনা হল, সংযমের কথা বলছেন সবাই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সংযম থাকছে না! অতীতে এ রাজ্যে বিনয় কোঙার, অনিল বসুদের কদর্য বাক্য বহু বিতর্ক তৈরি করেছে। তারও আগে প্রমোদ দাশগুপ্ত বা হরেকৃষ্ণ কোঙারদের জনসভার ভাষা সব ক্ষেত্রে শালীনতার গণ্ডি মানেনি। রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরবির্তনের পরে জ্যোতিপ্রিয়-শুভেন্দু-মদনেরা সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছেন! বিপরীত শিবির থেকে কখনও শোধ তুলে নিচ্ছেন আনিসুর রহমান বা দেবব্রত বিশ্বাসেরা। কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মতে, “রাজ্যের সার্বিক পরিবেশের একটা ছাপ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের আচরণে পড়ে। হতাশা এবং নৈরাজ্যের যে ছায়া এই রাজ্যের উপরে চেপে বসেছে, তারই প্রভাবে হয়তো বাক্সংযম হারাচ্ছে নেতাদের। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ভাষাও তো নিয়ন্ত্রণে থাকছে না!”
শুধু ভাষাই অবশ্য নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইদানীং কালের বিজ্ঞাপন অন্যত্রও মিলছে। যেমন প্রজাতন্ত্র দিবসে উত্তর শহরতলির সিঁথির মোড়ে তৃণমূলের অনুষ্ঠানে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৈত্যাকার কাট-আউটের পাদদেশে স্থান পেয়েছিল নেতাজি-গাঁধীজি প্রমুখ মনীষীদের ছবি! টিভি চ্যানেলে সেই ছবি প্রদর্শন শুরু হতেই অবশ্য মনীষীদের ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রজাতন্ত্র দিবসের ট্যাবলোয় মুখ্যমন্ত্রীর ছবির কুচকাওয়াজের পিঠোপিঠি সিঁথির মোড়ের টুকরো ছবি রাখলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্র স্পষ্ট!
ফব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রতবাবু কামারপুকুরের সমাবেশে তৃণমূল সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যের জন্য সোমবার অবশ্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন আনিসুরের মতোই। রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ-সহ দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার পরে দেবব্রতবাবু বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “পুরো প্রেক্ষিতটি না-বলে আমার বক্তব্যের আংশিক উদ্ধৃতি প্রচারিত হওয়ায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত যে ভাষা ও উপমা আমি ব্যবহার করেছিলাম, তাতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-বেদনার সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাষা ব্যবহার না-করাই শ্রেয়
ছিল। সমগ্র বিষয়টিতে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত এবং মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও তত ক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার, অবশ্য হয়ে গিয়েছে। ফব-রই রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “আমরা নিজেরাই নিজেদের অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছি! শাসক দলের আচরণে মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরি হলেও তাঁরা আমাদের দিকে আর ফিরে তাকাবেন না, এই রকম চলতে থাকলে! আর নেতারা এমন কথা বলে এলে নিচু তলার কর্মী-সমর্থকদের তার মাসুল দিতে হয়। তাঁরা পড়েন আক্রমণের মুখে।” সেলিম অবশ্য দাবি করছেন, “মাঝেমধ্যে আমাদের কথা শুনতে হয়, এত ভুল স্বীকার কেন? কিন্তু ভুল হয়েছে বুঝেই বাম নেতারা ভুল স্বীকার করেন, ক্ষমা চান। তৃণমূলের তো ভুল স্বীকারের কোনও প্রশ্নই নেই।
কারণ, তারা মনে করে, যা করছি, সেটাই ঠিক!”
তৃণমূল অবশ্যই বাম নেতার অশালীন মন্তব্যের ফায়দা তুলতে পুরোদস্তুর সক্রিয়। রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম যেমন এ দিন বলেছেন, “ফরওয়ার্ড ব্লকের কে এক জন নেতা হঠাৎ অশ্লীল কথা বলেছেন আমাদের দল সম্পর্কে! এই প্রতিযোগিতা তো চলছে! কখনও সিপিএম, কখনও আরএসপি বা ফব। বামফ্রন্টের রাজত্বে সিপিএম ছিল জমিদার। বাকিরা ছিল তার প্রজা। এখনও সিপিএমকে তুষ্ট করার জন্য বাকি দলগুলো প্রতিযোগিতায় নামছে! এঁরা রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার যোগ্য নন!” রাজ্যবাসীর প্রতি ফিরহাদের আর্জি, “এদের দেখবেন না। টেলিভিশনে নোংরা আলোচনা দেখবেন না। বয়কট করাই ভাল!”
তা হলে জ্যোতিপ্রিয় বা সৌগতবাবুদের নিয়ে কী করা হবে? ফিরহাদের পরামর্শ, “ওঁরা যা বলেছেন, তার সঙ্গে এটা মেলাবেন না। গুলিয়ে দেবেন না! এদের (বাম) সংস্কৃতিই হচ্ছে বাংলাকে ধ্বংস করা!”
কুকথারও আমরা-ওরা আছে এ বাংলায়! |
|
|
|
|
|