জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সংঘাত চরমে পৌঁছল। রাজ্য সরকার যে এক দিনে রাজ্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে ভোট করানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কমিশন তা আগেই মানতে অস্বীকার করেছে। উল্টে পঞ্চায়েত দফতরকে তারা জানিয়ে দিয়েছে, শান্তিপূর্ণ ভোটের স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে তিন দফায় ভোট হওয়া উচিত।
কমিশনের এমন আচরণে বেজায় চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত দফতরকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, কমিশন যা-ই বলুক, এক দফাতেই পঞ্চায়েত ভোট করতে হবে। রাজ্য ও কমিশনের এই দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে সোমবারই পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বৈঠক করেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে। কিন্তু কমিশনকে কী ভাবে বুঝিয়ে নরম করা যাবে, তা নিয়ে কোনও পথ এ দিন পর্যন্ত বেরোয়নি বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
এখানে প্রশ্ন উঠেছে, আইন অনুযায়ী পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঠিক করার অধিকার কার হাতে, রাজ্য সরকার না নির্বাচন কমিশন? সরকারি কর্তারা জানান, আইন অনুযায়ী ভোটের দিন ঠিক করবে পঞ্চায়েত দফতর। কিন্তু তা করতে হবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেই। আর যদি দু’পক্ষ সহমত না হয়? এই ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। ধরেই নেওয়া হয়, দু’পক্ষ একমত হলে তবেই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে সংশ্লিষ্ট দফতর। কিন্তু এ বারে এখনও পর্যন্ত মতৈক্যের দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত তা হবে কি না এবং হলে কবে হবে, তা-ও হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না।
আইনে এই ধোঁয়াশাই কিন্তু সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অধিকার কার, এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কমিশনের একাংশ বলছে, নির্বাচন কী ভাবে পরিচালিত হবে, তা ঠিক করার অধিকারী কমিশন। ফলে ক’দফায় ভোট হবে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী রকম
রাখা হবে, সে সবও চূড়ান্ত করার অধিকার একমাত্র কমিশনের। তাঁদের বক্তব্য, সরকারকে এ কথা মাথায় রাখতে হবে।
এর উল্টো ব্যাখ্যাও অবশ্য রয়েছে। পঞ্চায়েত দফতরের অফিসারেরা বলছেন, ভোটের দিন ঠিক করার দায়িত্ব রাজ্যের। আর দিন ঠিক করা এবং ক’দিনে ভোট হবে, দু’টি বিষয় আলাদা হতে পারে না।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, এর আগে কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মোটামুটি ভাবে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহমতই হোত। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোট তিন দফায় হয়। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে রাজ্য সরকারই তিন দিনে ভোট করার প্রস্তাব দেয়। অনেকেই বলছেন, এখন হয়তো পরিসংখ্যানের দিক থেকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা কমেছে, কিন্তু তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে বহু জায়গায়। ফলে নতুন করে আতঙ্কের পরিবেশও তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় এক দিনে ভোট হলে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েই সন্দিহান নির্বাচন কমিশন।
সে জন্যই কমিশনের কাছে রাজ্য যখন ২০ এপ্রিল এক দিনে ভোট করার প্রস্তাব দেয়, তার জবাবে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে সরকারকে পাল্টা প্রস্তাব দেন, ভোট হোক ২০, ২৪ এবং ২৮ এপ্রিল। কমিশন মনে করে, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে হলে তিন পর্বে ভোট হওয়া উচিত। এবং দু’টি পর্বের মধ্যে তিন দিনের ফারাক থাকা প্রয়োজন।
২৪ জানুয়ারির ওই চিঠিতে কমিশনার একই সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার বিষয়ে আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সেই বিষয়টি যেন রাজ্য সরকার মনে রাখে।” কমিশনের প্রস্তাব ছিল, প্রতিটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে সশস্ত্র পুলিশ রাখার ব্যবস্থা হোক। কমিশনের কর্তাদের মতে, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, প্রতিটি বুথে কমপক্ষে ২ জন করে সশস্ত্র পুলিশ রাখার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কমিশন সেই ধারাই বজায় রাখতে চায়।
পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে কমিশন এর মধ্যেই রাজ্যকে জানিয়েছে, ২০১০ সালে ৮১টি পুরসভার নির্বাচনের সময় ৪৮ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল। সেই সময় হুগলির কয়েকটি এলাকায় উত্তেজনা থাকায় সেখানে ভোটের আগের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী ফ্ল্যাগ মার্চ করে। তাতেই সে বারের ভোটে রক্তক্ষয় এড়ানো গিয়েছিল। এ বারেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে পঞ্চায়েত ভোট করা হলে রক্তক্ষয়ের আশঙ্কা এড়ানো যাবে বলে কমিশন মনে করে। বিশেষ করে রাজ্যের বিভিন্ন স্তর থেকে যে ধরনের খবর কমিশনের কাছে আসছে, তাতে তারা মনে করছে, পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে উত্তেজনা আরও বাড়বে। কমিশনের এক কর্তার কথায়, তিন দফায় ভোট করতে চাওয়ার পিছনে বুথ এবং ভোটারের সংখ্যাও অন্যতম কারণ। তিনি জানান, এ বার ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে বুথের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তুলনায় অন্তত ৮ হাজার বেশি। ভোটার বেড়েছে ৫৫ লক্ষেরও বেশি। এর সঙ্গে চলতি বছরে প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুযায়ী আরও কয়েক লক্ষ ভোটার বাড়বে বলেই কমিশন মনে করছে। কমিশন মনে করে, এক দিনে প্রতিটি বুথে কমপক্ষে ২ জন করে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করার মতো পুলিশ নেই রাজ্যে। |