প্রবন্ধ ২...
জীবনকে সহনীয় করার জন্য এক দরদি প্রতিবেদন
চার পাশের ব্যাপক ঘোমটা পরা খ্যামটা নাচ, মাদারির খেলা, ধর্ষণ, আস্ফালন, বড় পর্দার অন্তহীন নিতম্বনৃত্য, ছোট পর্দার কথার ফেনা ও ফুলঝুরি দেখেশুনে অনেকেরই আক্কেল গুড়ুম। শুধু এক জনের কথা মনে পড়ে যায়, ‘পাজীর টেক্কা ও বজ্জাতের বাদ্শা’-দের মুখোশ খুলে দেওয়ার আর ‘চকে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার’ ব্যাপারে আজও এই বঙ্গে যাঁর জুড়ি নেই: স্বয়ং হুতোম প্যাঁচা।
হুতোম নিশ্চয়ই জানতেন, ‘বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা অ তইরি কাদা’ নিয়ে ‘খ্যালা করা’ লোকজন সহজে ‘সুদরোয়’ না। ‘প্রকাশ্য বেলেল্লাগিরি বদ্মাইশী ও বজ্জাতি’র লাঘব হওয়া শক্ত। ‘দ্বিতীয় বারের গৌরচন্দ্রিকা’য় তিনি লিখেছিলেন, ‘অনেকে সুদ্রেচেন, সমাজের উন্নতি হয়েছে’। কিন্তু হুতোমের লক্ষ্য বাগ্যম্বর মিত্র, পদ্মলোচন দত্ত, ছুঁচো শীল, পেঁচো মল্লিক ও হুজুর আলিরা আজও সগর্বে বিরাজমান। ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’-র ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ও আজ অক্লেশে খুঁজে পেতেন বাঁশবাগানের টিয়ে, বাবলাতলার ঘুঘু, পচাপুকুরের ব্যাঙ কিংবা ধেড়ে প্যাঁচা।
রগড় করা ছাড়া যে ভূত ছাড়ানো যাবে না, হতাশার বেহ্মদত্যিকে ঘাড় থেকে নামানো যাবে না, চন্দ্রিল ধনুকে জ্যা-সংযোগ করার সময় বুঝেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি বুঝেছেন যে সুস্নাত লিপিতে এই পরিকীর্ণ রুচিহীনতার বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। হুতোম যাকে বলেছিলেন, ‘সাধারণ ঘরকন্নার কথা, Household words’, তাকে জোড়াসাঁকোর এই আদি বিকল্প ডিসকোর্সটি ছাড়া ধরা যাবে না।
সেই চন্দ্রিল, যিনি আগে ভয় পেতেন ‘কন্ধকাটা, রাত্রিবাথরুম, বস্তা কাঁধে লোক। তার পর: বজ্রগুণন, চড়-মারা স্যর, চোখ-মারা বন্ধু, ডিউস বল। তার পর: ভুসো তেলচিটে সন্ধে, নারীদের ভুকভুক হাসি, স্মার্টদের ব্যাকহ্যান্ড-ঝাপড়া, সুখীদের চমৎচাউনি। এখন: যৌবন চলে যাওয়ার স্পিড, নিশীথ-নেড়ি, গুটকা-ছেটানো পাছা-পাঁয়তারাময় পিলপিল পাবলিক, ধাবমান ধ্যাবড়া-যান, প্রাতে নিজমুখঘ্রাণ।’ তিনি যখন কলম ধরেন, সেটি কখনও লণ্ঠন, কখনও ত্রিফলা ছুরি।
হুতোমের ‘কলিকাতার চড়ক পার্ব্বণ’ কিংবা ‘কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা’ এবং চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ‘সাগরসঙ্গমে চন্দ্রিলকুমার’-এর ভাষাগত এবং চরিত্রগত মিল বিশেষ ভাবে লক্ষ করার মতো। একটি স্পেসকে অন্য একটি সমাজৈতিহাসিক স্পেসের মধ্যে যে ভাবে সেঁধিয়ে দেওয়া হয় তা চমকে দেওয়ার মতো:
“যেদিকে তাকাও শুধু হোগলার ছাউনি ও ঘর, জায়গায় জায়গায় গোল হয়ে বসে সমবেত গান। ‘গৌরদেশে যাবি তো মন পাসপোর্ট করা রে’ গেয়ে একজন আসর মাতাচ্ছেন। তাঁর আধুনিক ‘টাচ’ বহুত প্রশংসা কুড়োচ্ছে। বহু সাধুর স্টলে ব্র্যান্ড নিউ নামাবলি বিকোচ্ছে। সারে সারে ক্ষৌরকারও ক্ষুর উঁচিয়ে আছেন। ন্যাড়া হয়ে নামাবলি চাপিয়ে নেওয়া কয়েক মিনিটের ব্যাপার। অনেক সন্ন্যাসী টিভি চ্যানেলের সঙ্গে প্রাণপণে দরাদরি করছেন। না পোষালে পারফরম্যান্স দেবেন না।” (পূর্ববর্তী গ্রন্থ ‘রস কষ সিঙাড়া বুলবুলি মস্তক’, দে’জ)
‘হাহা হিহি হোহো ও অন্যান্য’তেও আছে:
“তারা লাইন দিয়ে আছে সোসাইটির সামনে, রিগালের সামনে, এলিটের সামনে, বাঁধাকপির পাতা পচছে মাইল মাইল জুড়ে, সেই গন্ধে তারা চুবিয়ে নিচ্ছে ন্যাতানো কলজে, তড়িঘড়ি এক টাকার বিফ রোল খেয়ে সেরে নিচ্ছে টিফিন, তাদের ঘাড়ময় খুশকি, কনুইয়ে খড়ির দাগ, খসখস করে আনমনে ছ্যাৎলাপড়া চামড়া চুলকোয়। একটা করে জ্যালজ্যালে লাল বা হলদে টিকিট খরিদ করে নিভু টর্চের মতো সামান্য ঝিকিয়ে ওঠে, ভাবে, কে বলতে পারে, এইবার, এইবার।”
এর পিছনে যে অভিনিবেশ ও গভীর চিন্তা কাজ করেছে, এবং শ্রম, তা চিন্তাশীল পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর প্রতিটি বাক্যের পর্ব-পর্বাঙ্গে সাপের ছোবল, এক মুহূর্তের জন্যেও ফাঁসটি আলগা হয় না, পাঠককে তিনি ছিপের নীচে মাছের মতো খেলাতে থাকেন। তাঁর তির অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, কারণ তিনি ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’র অন্যতম প্রাথমিক শর্তটি ভোলেননি: ‘আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিছি, এমনকি স্বয়ংও নক্শার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।’ চন্দ্রিলের বড় হওয়া ও বেঁচে থাকা এই রচনাগুলিকে বাড়তি শক্তি দেয়, সমাজের গ্রন্থিগুলি উন্মোচনের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে।
‘হাহা হিহি হোহো ও অন্যান্য’র সত্যজিৎ রায় বিষয়ক লেখাটিতে (‘ব্যাপার সহজপ্রাচ্য নয়’) খেলাচ্ছলে যা বলা হয়েছে তা অনেক চলচ্চিত্রবেত্তাকেও লজ্জা দেবে। সব কথা যে ঠিক তা অবশ্য নয়, (যেমন, “বিদেশিরা তাঁকে বলে, ‘কে এক ভারতীয় ঋষি-টাইপ, তাঁর ছবিতে হুড়ুদ্দুম নেই...।’” সারা পৃথিবীতে এমন আজগুবি কথা আমি শুনিনি।) কিন্তু এমন পাশুপতও আছে, যা যে-কোনও কফি-হাউজি ‘মুখেন মারিতং জগৎ’কে ধরাশায়ী করবে। যেমন সত্যজিতের আন্ডারস্টেটমেন্ট, যা ‘বুদ্ধি দিয়ে জারিয়ে নেওয়া, পরিশীলন দিয়ে সাঁতলানো।... বুদ্ধি আর সংযম ওঁর প্রতিভা এই দুই হাতে শরযোজনা করে।’ ‘চারুলতা’ ও ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে চুম্বকগুলি পাঠকের কাজে লাগবে। তবু বলব, পাঠক হঠাৎ এই গুরুগম্ভীর আলোচনার ফাঁকে ভুলে যান এটি চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের লেখা, যতক্ষণ না এমন বাক্য পাই: ‘বাঙালির ল্যাদাড়ুস মনপিণ্ড ঘাবড়ে চরকি খায়। এর প্রকৃত গ্যাঁড়াকলটা অন্য।’
বইয়ের যে রচনা তিনটি চন্দ্রিলের ট্রেডমার্ক বহন করছে, সেগুলি বাঙালির যৌনভাবনা নিয়ে তিনটি কাপড়-খুলে-দেওয়া বয়ান: ‘গোলাপি যে নামে ডাকো’, ‘বাঘ, ঘোগ, চোখভোগ’ ও ‘বোলো, ক্ষুধা তাকে ভোলেনি’। আমি নিশ্চিত যে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এগুলি উল্লেখযোগ্য ফুটনোট।
‘দগদগে পর্নোগ্রাফি’ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘সেসব দৃশ্য আমার খুলি হুপ্ করে খুলে নিয়ে ব্যাকভলি মারত।’ (‘বোলো, ক্ষুধা তাকে ভোলেনি’)। বাসে-ট্রামে মেয়েদের অনবরত অপমান বিষয়ে: ‘শুধু সেক্স নয়, উঁহু, সেক্স নয়, তীব্র দ্বেষ আছে এর মূলে, কশকশে গায়ের ঝাল, একটা চোখা, খোঁচওঠা, তেতো খার।’ (‘বাঘ, ঘোগ, চোখভোগ’)
জাঁ-ল্যুক গদারের দ্বিতীয় পর্যায়ের কয়েকটি ছবির মতো (যেমন Saure qui peut, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’) যৌনছবি হয়ে ওঠে বৃহত্তর সমাজের রাজনৈতিক রূপকল্প।
“সে হাসবে আর বিছিয়ে ফেলবে নিজেকে আর ক্রমাগত বলে যাবে ‘হ্যাঁ রাজি, হ্যাঁ রাজি’, আমার তলায় সে দাপিয়ে দাপিয়ে মরবে টিকটিকির মুখে ধরা অসহায় আরশোলার মতো, তার হৃদয় বলে কিচ্ছু নেই, ওঃ, কী আরাম, কী অবিশ্বাস্য আশীর্বাদ, তার হৃদয় নেই, আবেগ-ব্যাগেজ নেই, আমার কোনও দায় নেই... শরীর, শরীর, শুধু কাঁচা শরীর আছে, ফুলে ওঠা, আর্চ করা, হিসহিস করা শরীর, আছে অন্যের কথা একটুও না-ভেবে চোয়ালে চোয়াল চেপে নিষ্ঠুর আমিষ আক্রমণ শানিয়ে যাওয়া, আছে আমার গরম নোলা ক্যাতক্যাতে ইচ্ছের নিঃশর্ত সমর্থন...”
এই বারুণিবিলাস আর কাদা আর পুঁজকে হাড়মজ্জা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার নানা উপায় খুঁজতে খুঁজতে যারা এই জলাভূমিতে বেঁচে আছি, তাদের স্বীকার করতেই হবে, বিদ্রূপ আর হাসিঠাট্টার আড়ালে চন্দ্রিলের নকশা আমাদের জীবনপ্রণালীকে সহনীয় করার জন্য এক অশ্রুসজল, দরদি প্রতিবেদন।

হাহা হিহি হোহো ও অন্যান্য, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য। দে’জ
ঋণ: সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, অরুণ নাগ সম্পাদিত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.