প্রবন্ধ ১...
নিধিরামদের এক চিলতে সুযোগ
সে এক সময় ছিল। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, তবু নিধিরাম মাঝে মাঝে সর্দার হত, সর্দারি করতে পারত। সে গল্প বলতে পারত, কহাবট ও কহানি তৈরি করত, ওই সব গল্পেই তার কথা বলার ও কথা শোনানোর হকটুকু ছিল। গল্পের মজলিশও বসত, আসরে গরিবগুর্বোরা তো থাকতই, মাঝে মাঝে হেনরি এলিয়টের মতো রাজাগজারাও কথা শুনত, গল্প টুকে নিত, নেটিভদের জানতে ও বুঝতে হবে। সত্যি, সে সব এক দিন ছিল। লর্ড হার্ডিঞ্জ আর ডালহৌসির আমল, তখন সারা ভারতের ম্যাপটাই লালে লাল হয়ে গেছে। এত বড় সাম্রাজ্যের হাল-হকিকত বুঝতে সারা উত্তর ভারত জুড়ে দুঁদে প্রশাসক হেনরি এলিয়ট একেবারে সরেজমিন তদন্ত করে রাজস্ব ব্যবস্থার খতিয়ান তৈরি করছেন, প্রশাসনিক শব্দ সংকলন করছেন। আর তখনই নিধিরাম প্রজারা তাঁকে শোনাচ্ছে কোনও এক ‘হরযঙ্ক’ রাজার কথা, এক ‘অন্ধেরা নগরী’র গল্প, যেখানে মুড়ি-মিছরি এক দর, ‘টকা সের ভাজী, টকা সের খাজা।’ গল্পটা শুনে আর খুব ভাল করে টুকে রেখেও অস্যার্থ যে এলিয়ট বুঝেছিলেন, তা মনে হয় না, শোনা অর্থ তো বোঝা নয়। আবার, ১৮৫৭’র ঝোড়ো দিনের পরে ‘মহারানির সুশাসন’-এর আমলেও নিধিরামরা গল্পটা বলত, বাবু হরিশ্চন্দ্র ‘অন্ধেরা নগরী’র ‘চৌপাট’ রাজাকে নিয়ে জমাটি নাটকই লিখে ফেলেন, একেবারে আমাদের হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীর গল্প। সব এলাকাতেই নিধিরাম থাকত, তারা গল্প বলত। কে শুনবে আর কে শুনবে না, সেটা তো অন্য প্রশ্ন।
বারণ তো থাকতই, কিন্তু ঠেকানোও শক্ত। রাজা বদ, রাজার মাথায় দুটো শিং গজিয়েছে। চুল কাটতে গিয়ে ভবম হাজাম বা নাপিত দেখে ফেলেছে। ইচ্ছা করলেই তো নিধিরামরা সব গল্প বলতে পারে না, কথা চেপে রাখতেই হবে। হাজামের গল্প বলা চলবে না, বললেই রাজা মাথা কেটে নেবেন। কথা না বলতে পেরে ভবমের পেট ফুলে ঢোল। বেচারা গাছের কাছে কথা বলে এল, পেট ফোলাও সেরে গেল। গাছটা কাটা পড়ল, কাঠে ঢোল হল, কাঠি পড়ল, আর ঢোলের বোলে শোনা গেল রাজার মাথায় দুটো শিং, ‘কীহ্নে কহা?’ ‘কীহ্নে কহা?’ ‘ববন নে কহা।’ নিধিরামরা গল্প বলত, ঢোল-শহরতেই যেন গল্প ছড়িয়ে যেত, মুখে মুখে, এলাকা থেকে এলাকায়। সে দিন তো সেটাই ছিল মিডিয়া।
ছবি: সুমন চৌধুরী
গল্পের মধ্যেই তৈরি হত কথক, আসত তেনালি রাম, গণু ঝাঁ, গোপাল ভাঁড়রা, অবস্থা বুঝলে নিধিরামদের তরফে তারাই রাজা কৃষ্ণদেব ও কৃষ্ণচন্দ্রকে ন্যায়ধর্মের কয়েকটা পাঠ পড়িয়ে দিত। গরিব বামুনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও দুষ্ট সভাসদদের মন্ত্রণায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কথা রাখেননি, এই কথাটা তো গোপালের মতো নাপিতই রাজামশাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। নিধিরামদের গল্পে ঠিক এ রকমই হত। তাদের ইচ্ছে পূরণের জায়গা তো ওই গল্প বলা আর গল্প শোনা। গল্পের গরুর তো আর গাছে চড়তে বাধা থাকে না।
সে সাদামাটা সুখের সরল সময় আর নেই। গল্পের মজলিশেই চিড় ধরেছে, গল্পগুজব আর খবর-সংবাদ তো উল্টো জগতের বাসিন্দা, রসের কথা শুনলেই তথ্যসত্যের মুখ ভার হয়ে ওঠে। গল্পেতে নিধিরামরা জানত যে, প্রজাদের সুখদুঃখের খবর নেওয়াটা রাজা-বাদশাদের কর্তব্য। শোনার তাগিদটা তাঁদের দিক থেকেই থাকা উচিত। তাই দুর্মুখের কাছে খবর পাবার জন্য রামচন্দ্র বসে থাকতেন আর রাত্রে বোগদাদের পথে পথে ঘুরে হারুন-অল-রসিদ নিজেই প্রজাদের খবর জোগাড় করতেন, তাদের গরিবখানাতেই গল্প শুনতেন। সরকার ‘বেখবরি’ হলেই বাদশাও হয়ে পড়তেন ‘বে-আদিল’ ও ‘জালিম’, অত্যাচারী ও অপদার্থ। কিন্তু আজকের গণতন্ত্রে তো খাতায়-কলমে নিধিরামরা আর প্রজা নয়, বরং নাগরিক আর ভোটার। আশির দশকেই মান্যবর কাঁসিরাম তাদের ভাল মতোই শিখিয়ে দিয়েছিলেন ‘ভোট হমারা, রাজ তুমহারা, নেহি চলেগা, নেহি চলেগা।’ লাউসেনের বশংবদ কালু ডোম হতেও আর নিধিরামরা রাজি নয়। ফলে ওই সব বোগদাদি গল্পও আজকে আর তার সব কাজে লাগবে না। কিন্তু পরিবর্তে আছে কী? গণতন্ত্রে কথা বলতে ও বলাতে, শুনতে আর শোনাতে হয় আর একটা পরিসরে রেডিয়ো-খবরের কাগজ-টেলিভিশনের হাজারো চ্যানেলের সমন্বয়ে তৈরি করা একটা মায়াজগতে। এর মূলটি আছে উনিশ শতকীয় লিবারেল এনলাইটেনমেন্টের যুগে, আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি করার এক বিশেষ চিন্তায়। লোক জমায়েত হলেই ‘গণ’ হয় না, গণতন্ত্রকে কার্যকর ও বৈধ হতে হলে লোককে প্রবুদ্ধ ও ওয়াকিবহাল হতে হবে। সেটাই তো আসলি জনমত। ওই প্রবুদ্ধ জনমতই গণতন্ত্রকে বৈধ করতে পারে। জনমতকে ওয়াকিবহাল ও সচেতন করার দায়িত্ব পত্রিকার বা মিডিয়ার লোকেদের। ঠিক সংবাদ ও আলোচনাতেই লোকেরা উদ্বুদ্ধ হবে, আদানপ্রদান ও কথোপকথন মাধ্যমে জনমত প্রবুদ্ধ হয়ে উঠবে। সংবাদ মানেই আলাপ, সংলাপ বা কথোপকথন। মিডিয়ার আদর্শই তো সেই আলাপের ও আলোচনার পরিসর তৈরি করা। মিডিয়ার ঘেরাটোপেই তৈরি হবে জনমত, নাগরিক সমাজ হবে যুক্তিনিষ্ঠ।
ছকটি সাজানো। আজকের গোলকায়নের যুগে ছকটি ফুলেফেঁপে জোরালোও বটে। ওই ছকে নিধিরামদের গল্প বলা আর শোনানোর জায়গা কোথায়? নতুন পরিসরের ভাষা না জানলে, তাকে রপ্ত না করলে কি কিছু বলা আর শোনানো যায়? আগে যে ভাষায় নিধিরামরা গল্প বলত আর শোনাত, সেই ভাষা ছিল কোনও না কোনও সমূহের, কোনও না কোনও গাঁই-গোত্র-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যে ঋদ্ধ, ওই সমূহের সংস্কৃতিতেই তারা লালিতপালিত, তার জালেই তারা আবদ্ধ। ফলে, বলবার ও শোনাবার ভাষা খুঁজে পেতে তাদের অসুবিধে হত না, মুখে মুখে কহাবট বানাত, মডেল কখনও বা বামুন তুলসীদাস বা কৃত্তিবাস, কখনও বা জোলা কবীর, বেরাদরির তারিফে ও জোরে উতরেও যেত। আজকে ঝাঁ-চকচকে শহরে বা রিসর্টের ও বড়লোকি খামারের ছায়ায় ভাঙাচোরা গ্রামে নিধিরামরা নিঃসঙ্গ। সরকারি চোখে একক পরিচিতিতেই সে ভোটার ও নাগরিক, মেয়েমানুষ বা পুরুষমানুষ, সাবালক বা নাবালক, মাঝে মাঝে অবশ্যই সংখ্যালঘু বা তফসিলি; অন্য পক্ষে মিডিয়া গ্লোবাল, বিশাল ও রঙিন। জগতে তথা ভারতে রোজ অনেক ঘটনা ঘটে, হাতে গোনা কিছু ঘটনাই খবর হতে পারে, তাদেরই ‘নিউজ’ ভ্যালু থাকে। আর ওই সব খবর থেকেই বানানো হয় ‘স্টোরি’, রিজওয়ানুরের আত্মহত্যা বা জঙ্গলমহলের প্রতিরোধ। এই গল্প তৈরির কহানিকার হিসেবে নিধিরামদের কিছুই করার থাকে না। অবশ্যই গ্লোবাল সব সময় নিধিরামদের গল্প চায়, কারণ নানা রকমারি লোকালে জালের মতো ছড়িয়ে পড়াতেই তো থাকে গ্লোবালের কেরদানি। কিন্তু বাছা, বানানো আর ঝকঝকে করে হাজির করার সব সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব গ্লোবালের। এমনকী লোকালের আকাঁড়া বদখত রূপকেও কতটা নিখাদ ভাবে উপস্থাপিত করলে গ্লোবাল শ্রোতা ও দর্শকদের চিনে বেছে কিনতে ও শুনতে অসুবিধে হবে না, সে সব ভাবনা বেচাকেনার ক্ষমতার অলিন্দে নির্ধারিত হয়। সব দারুণ জনপ্রিয় ‘কহানি’র, থুড়ি, স্টোরির শিরোনামই তখন হয়ে ওঠে আজকের নিধিরামদের তকমা ও চাপরাশ। শূন্য নানা খোপে তারা বসে যায়। খোপগুলি রকমারি। কখনও প্রান্তিক আদিবাসী, কখনও ঝোপড়ির শিশুশ্রমিক, কখনও বা অত্যাচারিত অন্ত্যজ বা নারী। একটা শিরোনাম হবে, কিছু দিন থাকবে, আবার হারিয়ে যাবে। মার্কেটের চাহিদায়, ক্ষমতার দাবিতে অন্য আর একটি ঘটনা হয়ে উঠবে খবর। এ সব দেখবে শুনবে আমজনতা। কারণ, মিডিয়ার দায়িত্বই তো শিক্ষিত জনাদেশ তৈরি করা, ওই জনাদেশের দোহাই তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি।
নিধিরামরা দমে যাওয়ার পাত্র নয়, অন্তর্ঘাত জানে, সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনোর সুযোগ খোঁজে, বেশির ভাগ সময় হয়তো সুযোগটি পায় না। আগে তাদের গল্পে কর্তব্যের মাহাত্ম্য থাকত, এখন তাদের গল্পে অধিকারের কথা আস্তে আস্তে জেঁকে বসছে। এই তো, পাবলিকের অংশ হিসেবে তারাও ‘তথ্য জানা’র অধিকার পেয়েছে, প্রশাসনের খতিয়ান দেখার দাবি তারাও করতে পারে। হ্যাপা তো আছেই। কিন্তু কেবল বলা আর শোনা নয়, জানার অধিকার পাওয়াটা একটা বড় প্রাপ্তি, নিছক পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নয়। ‘এক’ থেকে ‘বহু’ হয়ে জোট বাঁধার ও কথা শোনাবার প্রকরণও বদলেছে। আশির দশকে শস্য-দাম ঠিক করার দাবিতে মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের ডাকে ধনী চাষিরা জমা হয়েছিল, মেরঠ আর দিল্লি অবরুদ্ধ করেছিল, নিধিরামরাও ভিড়ে ছিল, ‘খাপ’-এর ফরমান কে অস্বীকার করবে? আর আজ মোবাইল আর ট্যুইটারের ডাকে নিমেষে চেনা-অচেনা হাজার লোক যন্তরমন্তরে চলে আসে, মিডিয়া হামেহাল হাজির থাকে। বলা হয়, জমায়েতকারীরা শহুরে, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত; তবে তারই মধ্যে নিধিরামদের উঁকিঝুঁকি মারতে অসুবিধা হয় না। দামিনী কাণ্ডে বালিয়াতে টিভি রিপোর্টারদের ঢল নামে। কুলজি জানলে দামিনীর অনন্য লড়াইয়ের স্টোরি পোক্ত হবে। আবার সেই টানেই দিল্লির বাস-ড্রাইভার ও সব্জি-বিক্রেতা হয়ে ওঠে পুরুষতন্ত্রের জঘন্য প্রতিনিধি, দশকের জঘন্যতম রেপিস্ট। টিভি শো-তে এ হেন সব ঘটনার প্রেক্ষিতে আমজনতার অংশরূপে নিধিরামরা মাইক্রোফোন আসে। শো চলে, তাদের প্রশ্ন করা হয়, প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের ইঙ্গিত থাকে, ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বললেই কাজ চলে যায়। নিধিরামদের কাছে এটাই পরিসর, এটুকুই সুযোগ। এখানেই ‘হিংলিশ’ বা ‘বেঙ্গলিশ’কে কহাবট বা দেহাতি বুলির ঘরানায় সাজিয়ে তৈরি করা যায় এক নতুন ভাষা, এক নতুন লোকাল, নিধিরামদের কাহিনি বলা আর শোনার এক চকিত পরিসর। দলিত বা নির্যাতিত হিসেবে নয়, সাড়া জাগানো ঘটনার নায়ক বা শিকার হিসেবেও নয়, তথাকথিত ‘অ্যাচিভার’ বা বাহাদুর রূপেও নয়, বরং নিছক হরিদাস পাল বা নিধিরাম হয়ে জীবন কাটানোর কথা বলা ও শোনানোই তো একটা গণতান্ত্রিক কাজ। ওই নিধিরাম ঐকান্তিক কাজের পরিসরেই তো এক দিন হয়ে উঠবে গ্লোবাল মিডিয়ার অ্যাকিলিস হিল, লখিন্দরের অটুট লোহার বাসরে কালনাগিনী ঢোকার জন্য রেখে দেওয়া একটি ছোট্ট ছেঁদা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.