নিজের সীমা নিজেই অতিক্রম করছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক! প্রধান বিরোধী দল সিপিএম সম্পর্কে তাঁর সামাজিক বয়কটের নিদান এত দিনে রাজ্যবাসীর কাছে পরিচিত। এ বার তার সঙ্গে কংগ্রেসকেও জুড়ে তাঁর বিষোদগারের মাত্রা চড়ালেন খাদ্যমন্ত্রী!
বিরাটি বাসস্ট্যান্ডের কাছে এম বি রোডে বুধবার নেতাজির জন্মদিবস উপলক্ষে সভা ছিল তৃণমূলের। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ সেখানে উপস্থিত কর্মীদের উদ্দেশে জ্যোতিপ্রিয়বাবু প্রশ্ন করেন, “সিপিএমের সঙ্গে কী ব্যবহার করবেন আপনি?” নিজেই উত্তর দেন, “শুভেন্দু অধিকারী আমাদের নেতা। তিনি যে ভাষায় বলেছিলেন, আমি সেই ভাষাতেই বলছি। আপনি সাপের সঙ্গে কী ব্যবহার করেন? গোখরো সাপ, কেউটে সাপ যদি ঘরে ঢোকে, আপনি কী করবেন? সিপিএমের সঙ্গে সেই ব্যবহারই করবেন! কিচ্ছু করার নেই। নিকৃষ্টের দল! এক দম জঘন্য দল! পাতে ফেলা যায় না!”
অপ্রতিরোধ্য মন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “মাঝে মাঝে সিপিআইএম নামটা উচ্চারণ করতেই লজ্জা লাগে! মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের শুধু প্রত্যাখ্যানই করেছেন। এর পরেও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, তা হলে মেয়েদের ঝাঁটা, জুতো, লাথি খাবে এরা! জেনে রেখে দিন! সেই ব্যবস্থাই করবেন।”
কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি, অধীর চৌধুরী, নির্বেদ রায়, অরুণাভ ঘোষদেরও কটূক্তি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী। যা
|
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক |
শালীনতার সীমা ছাড়িয়েছে বলেই কংগ্রেসের অভিযোগ। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বৃহস্পতিবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “আমি কংগ্রেসের দু’জন নেতার কথা বলেছি। এক জন অবোধ অর্থাৎ অরুণাভ ঘোষ! অন্য জন নির্বোধ অর্থাৎ নির্বেদ রায়! এঁরা স্নো-পাউডার মেখে চ্যানেলে গিয়ে বসে থাকেন! আমি তো বর্ধমান (জ্যোতিপ্রিয়র মূল পারিবারিক বাসস্থান) থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে গাইঘাটা, হাবড়ায় এসেও জিতেছি। অরুণাভ ঘোষের তো নিজের ওয়ার্ডেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে! উনি যদি ওঁর বাড়ির দু’পাশ থেকে ১০ জন লোককে একসঙ্গে নিয়ে বার হতে পারেন, তা হলে আমি পদত্যাগ করব!”
রাজ্য রাজনীতিতে কুবাক্যের স্রোত এ ভাবেই ক্রমশ বেগবান হচ্ছে। জ্যোতিপ্রিয় নিজেই শুভেন্দুকে উদ্ধৃত করেছেন। তা বাদেও দলমত নির্বিশেষে নেতানেত্রীরা লাগামহীন কথা বলেই চলেছেন। রাজ্যে পালাবদলের আগে এ বিষয়ে বিশেষ নাম কিনেছিলেন সিপিএমের বিনয় কোঙার, অনিল বসুরা। পরিবর্তনের পরেও আনিসুর রহমান সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর বিষয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। বর্মা কমিটির রিপোর্টেও সে কথা উল্লিখিত হয়েছে। অন্য দিকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এক সভায় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ‘আমি কি ওঁকে গিয়ে মারব’ বলে বিতর্ক তৈরি করেছেন। সেই ধারাই বজায় রাখলেন জ্যোতিপ্রিয়। রাজনীতির কারবারিদের একাংশ এও মনে করছেন যে, এই জাতীয় কথাবার্তা তৃণমূল সমর্থকদের একাংশের মনঃপূত বলেই নেতারা ধারাবাহিক ভাবে এমন বলে চলেছেন!
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, জ্যোতিপ্রিয়কে ‘সংযত’ করার পরিবর্তে তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছেন! খাদ্যমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে এ দিন তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, “অতীতেও বলেছি, আজও বলছি সবাইকে সংযত হয়ে চলতে হবে। অসহিষ্ণু হলে চলবে না। পক্ষ-প্রতিপক্ষ, এ পক্ষ-ও পক্ষ সবাইকে বলছি!” তবে এই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে সেই নেতা সাংবাদিকদের ফোন করে জানিয়ে দেন, তাঁর বক্তব্য তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। কারণ, তাঁর কথায়, “জ্যোতিপ্রিয় যা বলেছেন, তা কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে পারব না। সেটা করলে মনে হবে আমি কংগ্রেসের পক্ষে কথা বলছি!”
যা শুনে কংগ্রেসের এক নেতার প্রতিক্রিয়া, “তাজ্জব ব্যাপার! কংগ্রেস সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা দেখালে তার মানে ক্ষতি নেই?” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের মতে, “জ্যোতিপ্রিয়বাবু এমন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচার পাওয়ার জন্য। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কথা, পঞ্চায়েত ভোটের আগে ওঁদের দলের লাইনটা এ ভাবে পরিষ্কার করে দিচ্ছেন!”
মন্তব্য করার পরের দিন, বৃহস্পতিবার খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য সাফাই দিয়েছেন, “সিপিএম দলকে আমি সাপ বলিনি। শাসনের সভায় গিয়ে সিপিএমের মজিদ মাস্টার প্রসঙ্গে এ কথা বলেছিলেন শুভেন্দু। আমি সে কথারই পুনরাবৃত্তি করেছি। শাসনে মজিদকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না!”
জ্যোতিপ্রিয়বাবু বুধবারের সভায় আরও বলেছিলেন, “আমি আগে বলেছি, এখনও বলছি সিপিএমের সঙ্গে জল খাবেন না, বাজারে যাবেন না, চায়ের দোকানে যাবেন না, কথাও বলবেন না! কোথাও যাবেন না!” পর দিন আবার তাঁর ব্যাখ্যা, “আমি সিপিএম দলের সব লোকের কথা বলিনি। ওই দলের ভদ্রলোকেরাও তো আমাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। আমি ওই দলের সমাজবিরোধীদের কথা বলেছি। সুভাষ চক্রবর্তী, অমিতাভ নন্দীদের কথা বলেছি। যাঁরা সঙ্গে কুখ্যাত সব সমাজবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন। মদত দেন।”
পাল্টা কটূক্তি ফিরিয়ে দিয়ে অরুণাভবাবুর প্রতিক্রিয়া, “যেমন নেত্রী, তেমন তার চ্যালা! নেত্রীরই ক্ষতি করছেন এই নেতারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার এই তো মান! বালুর (জ্যোতিপ্রিয়র ডাক নাম) জন্য শুভেচ্ছা থাকল! ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী হোক। মুখ্যমন্ত্রী হোক! তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর আসনটাই উঠে যাবে!”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির মতে, জ্যোতিপ্রিয়র এই আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পূর্ব-পরিকল্পনা নিয়ে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা এই ধরনের ব্যক্তিগত কুৎসা করছেন। দীপার কথায়, “সামনে পঞ্চায়েত ভোট। তৃণমূল নেতারা চেষ্টা করছেন, তাঁদের প্ররোচনায় বিরোধীরা পা দিক। তা হলে কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটলে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে, তার রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেই এ সব করা হচ্ছে!” দীপা দলীয় নেতৃত্বকে এই প্ররোচনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে জ্যোতিপ্রিয়ের খুনের অভিযোগ নিয়ে আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “আমাদের কুৎসা না-করে মানুষ যাতে রেশন পায়, কৃষক যাতে সহায়ক মূল্য পায়, সেটা খাদ্যমন্ত্রী দেখুন! কাজটা ভাল করে করুন!” অধীরের আরও বক্তব্য, “কেন্দ্রের দেওয়া কৃষকদের জন্য কোটি কোটি টাকা যে দফতর লুঠ করছে, উনি সেই দফতরের মন্ত্রী হয়ে সবই যখন জানেন, তখন তদন্ত করাচ্ছেন না কেন? আমি দিদিকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি!”
মন্ত্রী হয়ে জ্যোতিপ্রিয়র ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্য ‘অসাংবিধানিক ও অবৈধ’ বলে অভিযোগ করে খাদ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ।
তাঁর লাগাতার কটু মন্তব্যের জেরে এমন রাজনৈতিক চাপান-উতোর তিনিও কি সমর্থন করেন? জ্যোতিপ্রিয়বাবুর জবাব, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কারও নামে তো কিছু বলছেন না। কিন্তু চার জন লোক, দীপা-অধীর-নির্বেদ-অরুণাভ মুখ্যমন্ত্রীকে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করছেন। আমরা তো রক্তমাংসের মানুষ! আমাদের তো সহ্যের সীমা আছে!”
জ্যোতিপ্রিয়ের কাণ্ড দেখে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের যে কারণে সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!”
|