পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ সংক্রান্ত একটি মামলায় ত্রুটিপূর্ণ নথি পেশ করে বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে ভর্ৎসনার মুখে পড়ল রাজ্য সরকার। নথিটি পঞ্চাশ ফুট দূরে ছুড়ে ফেলার যোগ্য বলে শীর্ষ আদালতের মন্তব্যও শুনতে হল রাজ্যকে। এ হেন নথি দাখিল করে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য রাজ্যকে জরিমানা করেছিলেন বিচারপতিরা। পরে রাজ্যের কৌঁসুলি ভুল স্বীকার করে জরিমানা মকুবের আর্জি জানালে বিচারপতিরা তা মেনে নেন। তবে জরিমানার আদেশটি কোর্টের কার্যবিবরণীতে রাখতে বলা হয়েছে।
অর্থাৎ, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড ঘিরে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের বিরুদ্ধে গা ছাড়া মনোভাবের যে অভিযোগ গোড়া থেকেই উঠছে, সুপ্রিম কোর্টের এজলাসেও যেন তার ধারা বজায় রইল। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জিএস সিঙ্ঘভি ও বিচারপতি এইচএল গোখলের ডিভিশন বেঞ্চে এ দিন পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণে অভিযুক্ত সুমিত বজাজের জামিনের আবেদনের শুনানি ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযোগকারিণীর দেওয়া গোপন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির (১৬৪) নথি বেঞ্চে পেশ করেছিল রাজ্য সরকার। সেটিরই কিছু অংশে ক্রটি থাকায় বিচারপতিরা অসন্তুষ্ট হন। কী ত্রুটি?
সুপ্রিম কোর্টে সুমিত বজাজের কৌঁসুলি অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানিয়েছেন, রাজ্যের দাখিল করা জবানবন্দির নথিতে একটি নামের জায়গায় ‘ইললেজিব্ল’ (অর্থাৎ, অপাঠ্য) শব্দটি টাইপ করা ছিল। সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, কপি করার সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মী মূল নথির কোনও জায়গা বুঝতে না-পারলে সেখানে ‘ইল্লেজিবল’ লিখে রাখা প্রথা। এবং এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়ে থাকবে বলে সরকারি সূত্রের অনুমান।
কিন্তু ঘটনা হল, সুপ্রিম কোর্টে সেই জবানবন্দির নথি পেশ করার আগে তা শুধরে নেওয়া হয়নি। তাতেই বিচারপতিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা জানতে চান, এত গুরুত্বপূর্ণ নথিতে এমন ভুল কার গাফিলতিতে হল? এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত নথি শীর্ষ আদালতে জমা পড়ল কী ভাবে, এবং এর জেরে শুনানি ব্যাহত হওয়ার দায়ই বা কার, সে প্রশ্নও তোলেন। বস্তুত রাজ্য সরকারের ঢিলেঢালা আচরণ দেখে বেঞ্চের ক্ষোভ এ দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একটা সময়ে তারা মন্তব্য করে, ‘ওই নথি ছুড়ে পঞ্চাশ ফুট দূরে ফেলে দেওয়ার যোগ্য।’
রাজ্যের তরফে তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ড অভিজিৎ ভট্টাচার্য দোষ স্বীকার করে দ্রুত নথি ঠিক করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তাতেও বিচারপতিদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করার দায়ে রাজ্য সরকারকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করেন তাঁরা। পরে রাজ্যের তরফে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জরিমানা মকুবের আবেদন জানালে বিচারপতিরা তা মঞ্জুর করেন। তবে বেঞ্চ জানিয়ে রেখেছে, সর্বোচ্চ আদালতের রেকর্ডে এ দিনের ঘটনা পরম্পরা উল্লিখিত থাকবে। ২৯ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করে ওই দিন ত্রুটিমুক্ত নথি আদালতে পেশ করতে রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
শুধু এ দিনই নয়। পার্ক স্ট্রিট-মামলায় পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বার বারই প্রশ্ন উঠেছে। ধর্ষণের ঘটনার চার দিন পরে, ৯ জানুয়ারি ওই মহিলা পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে তাঁকে আমল তো দেওয়া হয়ইনি, উল্টে দুই পুলিশকর্মী তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তদন্তে তাঁরা দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। পাশাপাশি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারা ঠিক সময়ে মহিলার ডাক্তারি পরীক্ষা করায়নি।
এমন নানা ‘ঢিলেমি’র পরিপ্রেক্ষিতে লালবাজার নড়েচড়ে বসে, তদন্তভার হাতে নেয় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু তদন্ত চলাকালীনই মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘সাজানো ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করে দেন, যাতে কার্যত সুর মেলান পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎকুমার পচনন্দা। রাজ্যের কিছু মন্ত্রীও প্রকাশ্যে ধর্ষিতার চরিত্র-পেশা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সেই ঐতিহ্য বহাল রেখে তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার ক’দিন আগে এক টিভি চ্যানেলে ঘোষণা করে দিয়েছেন, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ হয়নি, যা ঘটেছে তা ওই ‘মহিলা ও খদ্দেরদের ব্যাপার!’ তৃণমূলপন্থী নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষও দিল্লি ও পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ‘প্রেক্ষিত’ আলাদা বলে মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।
তবে তদন্ত চালিয়ে গিয়ে অভিযুক্তদের কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছিলেন তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন। পুলিশের একাংশের মতে, ১৮ ফেব্রুয়ারি তিন অভিযুক্তের গ্রেফতারি মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দেয়। তার দু’দিন বাদে দময়ন্তীকে মহাকরণে ডেকে কথা
বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে দময়ন্তীর উপরে ‘রাজনৈতিক চাপ’ সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে পুলিশের একাংশের দাবি। এপ্রিলে দময়ন্তীকে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে রাজ্য পুলিশের
ডিআইজি (প্রশিক্ষণ) পদে বদলির ঘটনা যে দাবিকে আরও জোরালো করে তুলেছে।
এবং ঘটনার এগারো মাস পরেও পার্ক স্ট্রিট মূল অভিযুক্ত কাদের খান অধরা রয়ে গিয়েছে। এমনকী, চার্জশিট পেশ হলেও চার্জ গঠন এখনও হয়ে ওঠেনি। উপরন্তু সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি সম্প্রতি জানিয়েছে, পার্ক স্ট্রিটের পাঁচতারা হোটেলটির সিসিটিভি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হার্ড ডিস্কে ঘটনার রাতের ছবি পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন অভিযোগকারিণীর আইনজীবী। তথ্য পুনরুদ্ধারের জন্য হার্ড ডিস্ক ল্যাবের সদর দফতরে পাঠানোর আর্জিও জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগকারিণীর আক্ষেপ, রাজ্য সরকার প্রতিটি পদে মামলাটিকে ‘লঘু’ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ দিন সর্বোচ্চ আদালতে ত্রুটিপূর্ণ নথি দাখিলের মধ্যে সেই মানসিকতারই প্রতিফলন দেখছেন তাঁর আইনজীবীরা।
|