রোজগার হয় না, কারণ প্রাপ্যের চোদ্দো আনাই চোরের পকেটে। তস্কর-রাজের নিত্যনতুন
নজির পশ্চিমবঙ্গে। আলো চুরির সেই আঁধার ছবি দেখল আনন্দবাজার। |
মাথায় গনগনে গ্রীষ্মের সূর্য। ভরদুপুরে ভটভট করে পাম্প চলছে। সেচ-খাল শুকনো, অগত্যা মাটির নীচ থেকে জল উঠছে। ফুটি-ফাটা চাষের মাঠে জল দিতে হবে তো!
গ্রামের নাম শীতলগ্রাম। জেলা বীরভূম। থানা নলহাটি। তা, পাম্প চলছে কীসে? ডিজেলে, নাকি বিদ্যুতে?
হঠাৎ পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কর্তারা দেখলেন, সব ক’টা পাম্প চলছে বিদ্যুতে। অথচ খাতাপত্র ঘেঁটে দেখা গেল, সেচ-পাম্পের জন্য লাইন চেয়ে গ্রামের কেউ আবেদনই করেননি! বাড়তি বিদ্যুৎ জোগাতে ট্রান্সফর্মারও বসেনি। তা হলে?
তদন্ত করে ওঁদের চোখ কপালে! গ্রামের ভিতরে মিলল চোরাই ট্রান্সফর্মার। একটা নয়, দু’-দু’টো! তা দিয়ে গ্রিড থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ টেনে নেওয়া হচ্ছিল! |
হুকিং। নলহাটি থানার ভগলদিঘি গ্রামে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম |
রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তারা এত দিন মিটারে কারচুপি দেখেছেন, এক বাড়ির লাইন থেকে দশ বাড়িতে আলো-পাখা চালাতে দেখেছেন। ট্রান্সফর্মার, ওভারহেড তার কিংবা মিটার থেকে বিদ্যুৎ হাতানোর নজিরও ভুরি ভুরি। কিন্তু চোরাই ট্রান্সফর্মার বসিয়ে সমান্তরাল সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই সাম্প্রতিক ঘটনায় তাঁরা হতবাক। চোরাই ট্রান্সফর্মার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। “তবে এটা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।” বলছেন বণ্টনের এক অফিসার।
বস্তুত চুরির দাপটে কর্তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। বণ্টনের তদন্ত বলে, রাজ্যের নানা জায়গায় ১০০ টাকার বিদ্যুৎ ব্যয় হলে সংস্থা পাচ্ছে সাকুল্যে ২০ টাকা। আশি টাকা চোরের পকেটে! এক বণ্টন-কর্তার কথায়, “বেশি বাড়িতে আলো জ্বললে আমরা ভাবছি, গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কৃতিত্ব। পরে দেখছি, পুরোটাই চুরির বিদ্যুৎ! কোম্পানির ভাঁড়ারে কিছুই ঢুকছে না!”
ফলে ক্ষতির বহর দেখে বণ্টন-কর্তারা যারপরনাই শঙ্কিত। ওঁদের হিসেবে, শুধু চুরির ফাঁদেই বছরে তিনশো-সাড়ে তিনশো কোটি টাকার রাজস্ব গলে যাচ্ছে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যুতের চাহিদা সে ভাবে বাড়ছে না। এমতাবস্থায় চুরির রমরমা বিদ্যুৎ পরিবহণের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দেবে কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা।
বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে সরকার জরিমানা, কারাদণ্ডের বিধান-সহ কড়া আইন প্রণয়ন করেছিল। গোড়ায় অভিযানে পঞ্চায়েতের সাহায্য নেওয়া হতো। পরে পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। তৎকালীন রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদে (পর্ষদ ভেঙেই বণ্টন সংস্থা তৈরি হয়েছে) অতিরিক্ত ডিজি পদমর্যাদার এক আইপিএস অফিসারকে ‘নিরাপত্তা পরামর্শদাতা’ হিসেবে বসানো হয়। তাঁর পরামর্শে গত ক’বছরে পুলিশি মদতে বেশ ক’টা অভিযান চলে। এতে চোরদের মনে কিছুটা ভয় ধরানো গিয়েছিল বলে বণ্টন-কর্তাদের দাবি। ভয় কি রাতারাতি উবে গেল?
বিদ্যুৎ-কর্তারা জানাচ্ছেন, গত বছর ১ ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে হুকিং-বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তার পরে মহাকরণের নির্দেশে অভিযান কার্যত বন্ধ। কারও শাস্তি হয় না। আর এই ঢিলেমিরই ফায়দা লুটছে কিছু লোক। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় কোনও ব্যবস্থা না-নিয়েই ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মীরা।
রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুত গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের কাজ অবশ্য চলেছে পুরোদমে। নতুন নতুন জায়গায় ওভারহেড তার পৌঁছে গিয়েছে। খুঁটি, ট্রান্সফর্মার বসেছে। এবং শাস্তির ভয় না-থাকায় সেই বিদ্যুতে চোরের থাবা আরও পোক্ত হয়েছে। বণ্টনের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, বৈধ-অবৈধ গ্রাহকের অনুপাতটা কোনও কোনও অঞ্চলে কুড়ি-আশিতে গিয়ে ঠেকেছে! এমনকী, কোথাও কোথাও চুরির বিদ্যুৎ সস্তায় বিক্রির প্রমাণও তদন্তকারীরা পেয়েছেন বলে বণ্টন-সূত্রের দাবি।
যেমন নলহাটি-মুরারই।
লোকসানের নিরিখে বণ্টন সংস্থা সম্প্রতি যে ৫০টি গ্রাহক পরিষেবাকেন্দ্রকে চিহ্নিত করেছে, সেই তালিকায় রামপুরহাট মহকুমার এই দুই এলাকা একেবারে শীর্ষে। দেখা যাচ্ছে, নলহাটি কেন্দ্রে বছরে প্রায় ৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সংস্থার ঘরে আসে না। অর্থাৎ, ইউনিটপিছু দর পাঁচ টাকা ধরলে শুধু নলহাটিতেই সংস্থার বছরে গচ্ছা যাচ্ছে ৪০ কোটি! সংস্থার তদন্ত এ-ও বলছে, কোথাও কিছু রাজনৈতিক নেতা সমান্তরাল ‘বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থা’ চালাচ্ছেন। মাসিক টাকার বিনিময়ে যাঁরা গ্রিডের বিদ্যুৎ বেআইনি ভাবে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। তাঁরাই আবার মানুষকে বৈধ সংযোগ নিতে বাধা দিচ্ছেন!
দুই মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও দুই ২৪ পরগনাতেও লুঠেরাদের রমরমা চেখে পড়ার মতো। কিন্তু বীরভূমের কিছু তল্লাটে তাদের এত বাড়বাড়ন্তের কারণ কী?
বণ্টন সংস্থার বীরভূমের রিজিওন্যাল ম্যানেজার মানিক পালের ব্যাখ্যা, “হুকিং, মিটারে কারচুপি, অনাদায়ী বিল ছাড়াও অবৈধ সেচ-পাম্পের মাধ্যমে এখানে বিস্তর বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। পাথরখাদানে অবশ্য পরিমাণটা নগণ্য।” তিনি জানান, রামপুরহাটের মাড়গ্রাম এবং বোলপুর মহকুমার লাভপুর ও কীর্ণাহার গ্রাহক পরিষেবাকেন্দ্রেও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বিদ্যুৎ চুরির দৌলতে বহু জায়গায় ভোল্টেজ ঠিক থাকছে না।
গ্রামবাংলার বিদ্যুৎ-চিত্রটা আপাতত এমনই অন্ধকার। চুরির মাসুল গুণতে বৈধ গ্রাহকেরাও জেরবার। দাওয়াই কী? (চলবে) |