জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
রাজনৈতিক হানাহানির আশঙ্কায় প্রতিটি বুথে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রেখে পঞ্চায়েত ভোট করাতে চায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এ জন্য ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী, অর্থাৎ ৬৫ থেকে ৭০ হাজার জওয়ান প্রয়োজন বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে জানিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে।
অতীতে কখনও রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। রাজ্য পুলিশ বাহিনী এবং হোমগার্ড দিয়েই ভোট হয়েছে। ফলে কমিশনের প্রস্তাব পেয়ে কিঞ্চিত বিস্মিত রাজ্য সরকার। তবে এ নিয়ে প্রশাসন এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। স্বরাষ্ট্র দফতর প্রস্তাবটি খারিজও করেনি, আবার কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার উদ্যোগও শুরু করেনি। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আগে ভোট কখন হবে, তা ঠিক হোক। তার পরে কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে ভাবা যাবে।”
কিন্তু কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন? এবং এত বেশি সংখ্যায় কেন? মীরা পাণ্ডে এই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কমিশনের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্যে গত বিধানসভা ভোট হয়েছে ছ’টি পর্যায়ে। বুথ ছিল ৫২ হাজার (২০ হাজার অতিরিক্ত বুথ-সহ)। মোতায়েন করা হয়েছিল ৯০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। সমস্ত ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন হয়েছিল। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে শহরে ভোট নেই। তবুও অন্তত ৫৭ হাজার বুথে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। বুথ পিছু ভোটারের সংখ্যা ৮৫০ থেকে ১২০০।
কমিশনের ওই মুখপাত্র জানান, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনটি পর্যায়ে ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল। এ বার চারটি পর্যায়ে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, কলকাতার লাগোয়া জেলাগুলি এবং মাওবাদী প্রভাবিত জেলাগুলিতে আলাদা আলাদা দিনে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন রিপোর্ট দেখে এবং রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পরে কমিশন মনে করছে, রাজ্যে এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে। এবং মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার পর্ব থেকেই অশান্তি শুরু হতে পারে। কমিশনের এক মুখপাত্র জানান, রাজনৈতিক সংঘর্ষ এখন অনেকটাই কমে এলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটের আগে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাবে। কারণ, গত বিধানসভা ভোটের ঠিক পরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন আর নেই। গত কয়েক মাসে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শাসক ও বিরোধী দলের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলেছে। কোথাও যেমন শাসক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়েছে, তেমনই অনেক জায়গাতেই মাথাচাড়া দিয়েছে বিরোধীরা। ফলে পঞ্চায়েত ভোটে হানাহানির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকী পঞ্চায়েতের কয়েক হাজার আসনে হিংসার জেরে বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ওই মুখপাত্রের বক্তব্য, এই কারণেই আগাম ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া হয়েছে।
২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অশোক গুপ্ত প্রতি বুথে রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে ভোট করার প্রস্তাব দিলেও বাম সরকার তাতে রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, রাজ্যের হাতে পর্যাপ্ত বাহিনী নেই। ফলে প্রতি বুথে সশস্ত্র বাহিনী দেওয়া যাবে না। সে বছর পঞ্চায়েত ভোটে বুথে বুথে অস্থায়ী হোমগার্ড রাখা হয়েছিল। সে জন্য ৮০ হাজার অস্থায়ী হোমগার্ড নিয়োগ করা হয়েছিল। তৎকালীন রাজ্য পুলিশের আইজি, আইন-শৃঙ্খলা (বর্তমানে এডিজি কোস্টাল পুলিশ) রাজ কানোজিয়া বলেন, “যত দূর মনে পড়ছে, সংবেদনশীল বুথগুলিতে সশস্ত্র পুলিশ দেওয়া হয়েছিল। অন্য বুথগুলিতে লাঠিধারী পুলিশ ও হোমগার্ড মোতায়েন করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসেনি।” স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ মিলিয়ে এখন ৮৩ হাজার পুলিশ রয়েছেন। তার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীতে রয়েছেন বড় জোর ৩৫ হাজার। ফলে কোনও অবস্থাতেই প্রায় ৬০ হাজার বুথে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা সম্ভব নয়।
স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনা করাটা এক কথায় অসম্ভব। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য খরচের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে বলে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ মনে করেন। রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধায় মনে করেন, কমিশনের প্রস্তাব নিতান্তই অবাস্তব। তাঁর কথায়, “৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে অন্তত ২৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা কে দেবে? চরম অর্থসঙ্কট চলছে। এমনিতেই পঞ্চায়েত ভোটের যাবতীয় খরচ রাজ্যকে বহন করতে হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে তো খরচ বহু গুণ বেড়ে যাবে!” পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার আশঙ্কাও কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন সুব্রতবাবু। তাঁর দাবি, “রাজ্যে এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভাল। রাজ্যপালও কেন্দ্রীয় সরকারকে তা বার বার জানিয়েছেন। সিপিএমের আমলে যে ভাবে রাজনৈতিক হানাহানি হত, তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী লাগবে কেন? তা ছাড়া, আগে কমিশন ভোটের দিন ঠিক করুক, তার পরে পুলিশ নিয়ে ভাবা যাবে।”
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে সিপিএমের মনোভাব কী? বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এই মনোভাব সরকারি ভাবে জানি না। তবে কমিশন রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার হাল বুঝতে পেরেই হয়তো এমন প্রস্তাব দিয়েছে। বেহাল আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরেই বলছি। নিরাপত্তার ব্যবস্থা যথাযথ না হলে নির্বিঘ্নে ভোট হবে কী ভাবে?” |