নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কার্টুন-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জরিমানার সুপারিশ করেছিলেন তিনি। তাতে উষ্মা প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘‘বাইরে থেকে এনে যাঁকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হল, তিনিই যেন এখন কলমের আঁচড়ে সরকার চালাচ্ছেন।’’
তবু দমেননি রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সেই চেয়ারম্যান, প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়।
এ বার তিনি মুখ খুললেন প্রশাসনে দলতন্ত্রের অনুপ্রবেশ নিয়ে। সমালোচনার আঙুল তুললেন পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের মতো ঘটনা থেকে শুরু করে সরকারি আমলা ও পুলিশ-কর্তাদের জনসভার মঞ্চে
তুলে সরকারের প্রশংসা করানোর মতো বিবিধ বিষয় সম্পর্কে। তাঁর বক্তব্য: “প্রশাসনে দলতন্ত্র আগের আমলে ছিল ঠিকই। কিন্তু এখন যা চলছে, পরিস্থিতি তখন এতটা খারাপ ছিল না।” |
শনিবার এক আলোচনাচক্রে। —নিজস্ব চিত্র |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পরে গত এপ্রিলে অশোকবাবুকে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। তাঁর মুখে প্রকাশ্যে এই সমালোচনা স্বাভাবিক ভাবেই সরকারের অস্বস্তি বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট। তবে রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এ ধরনের কথা বলার এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে পদে, যে দায়িত্বে আছেন, তার সঙ্গে এ সমস্ত বক্তব্য মানানসই নয়।”
শনিবার বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার বেকবাগান এলাকায় একটি ক্লাবে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ক্যালকাটা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পুলিশ বিভাগের সংস্কার নিয়ে আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিল। ‘মেকিং পুলিশ রিফর্মস রিয়েল’ শীর্ষক ওই আলোচনায় অন্যতম বক্তা ছিলেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তথা ওড়িশা ও তামিলনাড়ুর প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় এবং রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) অবসরপ্রাপ্ত অধিকর্তা অমিয়কুমার সামন্তও ওই আলোচনা-চক্রে উপস্থিত ছিলেন। ডাক পেয়েছিল সংবাদমাধ্যমও।
সেখানে সরাসরি নাম না-করে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ড এবং সেই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধানের পদ থেকে দময়ন্তী সেনের বদলির বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে অশোকবাবুর বক্তব্য, “তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে সরকারের বদল হলে একশোরও বেশি আইএএস অফিসারকে রাতারাতি বদলি হতে হয়। এখনও এই রাজ্যে এ রকম শুরু হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে যে হবে না, সেটা কে বলতে পারে?” |
প্রশাসনে দলতন্ত্র আগের আমলে ছিল
ঠিকই।
কিন্তু এখন যা চলছে, পরিস্থিতি
তখন
এতটা খারাপ ছিল না।
প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় |
বিচারপতির এটা কাজ নয়। এ জন্য সূর্যকান্ত
মিশ্র আছেন।
এ ব্যাপারে যে উত্তর দেওয়া যায়,
আমাদের রুচিতে
বাধছে বলে তা বলতে পারছি না।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় |
|
এ কথা বলে তিনি নাম না করে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। অশোকবাবুর কথায়, “এই রাজ্যেই হওয়া সাম্প্রতিক একটি ঘটনার প্রতি আমি আলোকপাত করতে চাই। সেখানে সঠিক পথে এগিয়ে একটি অপরাধের তদন্ত করার জন্য এক জন ভাল অফিসারের কী পরিণতি হয়েছিল, আমরা সবাই জানি। তাঁকে বদলি করা হয়েছিল। কারণ, ‘পলিটিকাল বস’-এর বক্তব্যের উল্টো কথা তিনি বলেছিলেন।” অশোকবাবুর মন্তব্য, “আমি সরাসরি নাম করছি না। সবাই বুঝতে পারছেন। কিন্তু এ রকম ঘটনায় পুলিশ বাহিনীর মনোবল কোথায় গিয়ে ঠেকবে?” এর পরেই তিনি বলেন, “আমি বলছি না, এটা শেষের শুরু। কিন্তু এটা বলব, এটা এই রাজ্যে প্রশাসনে দলতন্ত্রের শুরু। তা বলে আমি কিন্তু আগের জমানার প্রশংসা করছি না। সেই সময়েও প্রশাসনে দলতন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। কিন্তু এখনকার মতো এতটা খারাপ অবস্থা তখন ছিল না।” তাঁর কথায়, “প্রশাসন সমালোচনা সহ্য করতে পারছে না। এই ব্যাপারে প্রশাসন ক্রমশ বেশি করে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে।”
|
রাজ্য মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫ |
• চেয়ারপার্সন ও সদস্যদের নিয়োগকর্তা রাজ্যপাল।
• নাম সুপারিশ করেন মুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভার স্পিকার, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা।
• বর্তমান চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন গত এপ্রিল মাসে। |
|
সভায় উপস্থিত শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চান, পুলিশের শীর্ষ কর্তাকে জনসভার মঞ্চে মাইক ধরিয়ে দিয়ে যদি সরকারের কাজকর্মের প্রশংসা করতে বলা হয়, তাতে কি ওই অফিসারের মর্যাদা রক্ষা করা হয়? জবাবে মানবাধিকার চেয়ারম্যান বলেন, “জনসভায় রাজ্য পুলিশের ডিজি, মুখ্যসচিবের হাতে মাইক ধরিয়ে দিয়ে (মুখ্যমন্ত্রী যেমন করে থাকেন) বলা হচ্ছে, ‘বলুন, আমি যা বলেছি, ঠিক বলেছি কি না’ এমনটা কখনও এই রাজ্যে হয়নি। এটা তো আইএএস, আইপিএস অফিসারদের সার্ভিস রুল-এর বিরোধী। সরকারি অনুষ্ঠানের নামে আদতে যা রাজনৈতিক জনসভা, সেখানে পুলিশের ডিজি চলে যাচ্ছেন। এ সব কী হচ্ছে?”
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এই মন্তব্যের বিরোধিতা করে রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য: “এটা প্রশাসনের কাজ। তাতে ওঁর কী এসে যায়! এটা কি কোনও সাংবিধানিক সমস্যা তৈরি করেছে, না আইন ভেঙেছে!” সুব্রতবাবুর মতে, “বিচারপতির এটা কাজ নয়। এ জন্য সূর্যকান্ত মিশ্র আছেন। এ ব্যাপারে যে উত্তর দেওয়া যায়, আমাদের রুচিতে বাধছে বলে তা বলতে পারছি না। উনি যদি পদ ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি করেন বা সাধারণ নাগরিকও হন, তা হলে যথার্থ উত্তর আমাদের কাছে আছে, তা দিয়ে দেব।” |