একটা ময়লা রঙের, ঝাঁকড়া চুলের মেয়ে, বয়স বছর ছয়েক, খেলতে খেলতে মাঝে মাঝেই এসে রান্নাঘরে মা’কে দেখে যায়। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, আর পারছে না, তবু অপেক্ষা করে কখন বাবা অফিস থেকে ফিরবে। না, শুধু ভালবাসার টানে নয়, আজকাল রোজ রোজ সব সময় সে মিলিয়ে নেয় বাবা-মা’র ভালবাসা কিংবা বকুনির প্যাটার্ন। স্কুল থেকে ফেরার পর মা কি স্কুল-ড্রেস ঠিক জায়গায় না রাখার জন্য একই রকম ভাবে বকল? আচ্ছা, বাবা কি সকালবেলায় ঘুম থেকে তোলার সময় আজ পাঁচ মিনিট কম খেলল? দিদিকে কি মা সত্যি সত্যি টিফিনে গোটা ডিম দিয়েছে আর আমায় আধখানা? দিদির ছোট হয়ে যাওয়া সোয়েটার আমায় পরায় ইচ্ছে করে, আমায় কিছুতেই নতুন কিনে দেবে না বলে?
তা হলে কি কাকুমণি আর বুকানদাদা আর জেঠিমণি যা বলে সব সত্যি? কাল কিংবা পরশু বা যে কোনও দিন একটা উটকো লোক আর একটা অচেনা মহিলা এসে বলবে যে আমি আসলে ওদের মেয়ে, সত্যি সত্যি আমি হাসপাতালে বদলি হয়ে গেছিলাম আর ওরা এত দিনে হাসপাতাল থেকে ঠিকানা নিয়ে আমাকে নিতে চলে এসেছে? কাকুমণি এই কথাটা বলার সময় প্রমাণ হিসেবে সব সময় বলে, দ্যাখ দিদি কীরকম ফর্সা আর তুই কী রকম কালো। মা-বাবার সত্যি মেয়ে হলে তুইও ও রকম ফর্সা হতিস। তাই তো। শোওয়ার সময় দিদির পাশে নিজের হাত মিলিয়ে দ্যাখে, একদম বেমানান!
খুব কান্না চাপতে হয় আজকাল। রোজ শোওয়ার সময় সে ঠাকুরকে বারবার বিড়বিড় করে বলে, ঠাকুর কাল যেন কেউ না আসে আমায় নিতে। মাঝে মাঝে ব্যাপারটা এত নিজে নিজে চাপা থাকে না। মা’র কোলে মুখ গুঁজে সে জিজ্ঞেস করে, আমি হওয়ার সময় তুমি ভাল করে দ্যাখোনি মা? সত্যি আমায় বদল করে নিয়েছে? মা হেসে কুটিপাটি। বলে, ও সব বাজে কথা সোনা, তোমায় খ্যাপাচ্ছে সবাই। কিন্তু খ্যাপালে বুঝি রোজ রোজ সবাই একই কথা বলে? কাকুমণি আর বুকানদাদাকে দেখলে সে অন্য ঘরে ছুট্টে পালায়। আর বেল বাজলে ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে থাকে, এই বুঝি কেউ নিতে এল তাকে। তার পরেই ছুট্টে দেখতে যায়, কে এল। চেনা লোক দেখলে স্বস্তি পায়। আর অচেনা দেখলেই ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, কী চায়? কী বলতে এসেছে? এই ভয় নিয়ে কেটে যায় তার ছ’বছরের জন্মদিন, পেরিয়ে যায় সাত বছরের জন্মদিন। সে বড় হয়, কিন্তু ভয়টা ছোট হয় না।
জানলার ধারে একা একা ভাবতে থাকে, কেউ এসে চাইলেই মা-বাবা আমাকে দিয়ে দেবে? তা কখনও হয়? আমি যে ওদের অ্যাত্ত ভালবাসি, ওরা কি আমায় একটুও ভালবাসে না? যে আসবে সে কি অনেক কাগজ নিয়ে এসে কী সব লেখা দেখাবে আর মা হাপুস কেঁদে সুটকেস গুছিয়ে দেবে? আমি যদি যেতে না চাই? তা হলেও চলে যেতে হবে? আর সেই বাড়িটা কী রকম হবে? কাকে বাবা বলে ডাকতে হবে? সে কি স্কেল দিয়ে মারে? কোন স্কুলে যেতে হবে? দিদির সঙ্গে খেলার কী হবে? একেবারে অথই জলে পড়ে যায়।
একটু বড় হওয়ার পর এই নিষ্ঠুর মজাটার মানে বুঝতে পারে ময়লা মেয়েটা। নিজেও তখন খুব হাসে, রসিকতা করে। কিন্তু সেটা বানানো। রাত্তিরে মা’কে চেপ্পে ধরে শুয়ে থাকার আর শিউরে শিউরে ওঠার মুহূর্তগুলো তার মনে অনেক নখ বসিয়েছে, সেই দাগগুলো যায় না। |