|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: সাররিয়ালিজ্ম
|
গৌতম চক্রবর্তী |
চিত্রকলা ও কবিতার ম্যানিফেস্টোকে কখনও কখনও বিজ্ঞানের কাছে ঋণী থাকতে হয়। সিপাহি বিদ্রোহের আগের বছর, ১৮৫৬ সালে ভিয়েনায় সিগমন্ড ফ্রয়েড নামে এক মনোবিজ্ঞানী না জন্মালে বিশ শতকের প্যারিস শহরে ‘সাররিয়ালিজম্’ শব্দটা আদতে তোলপাড় ফেলত কি না, ধন্দ রয়েছে। ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্যারিসের ‘ক্রা’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে সাররিয়ালিজ্মের প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরোয়। কবি আঁদ্রে ব্রেতঁর লেখা সেই ঢাউস ম্যানিফেস্টোর পাতায় পাতায় ফ্রয়েডের নাম। ‘ফ্রয়েডকে তাঁর আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ’, ‘ফ্রয়েড না থাকলে স্বপ্নের গুরুত্ব এত সহজে বোঝা যেত না’। আমাদের মনে পড়তে পারে, বিশ শতক শুরুর আগেই, ১৮৯৯ সালে বেরিয়ে গিয়েছিল ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিম্স’।
স্বপ্নকে জানতে হবে। আমাদের সুষুপ্তি-আচ্ছন্ন স্বপ্নেই তো থাকে অচেতন মনের গোপন গুঞ্জন। সামাজিক চাপে যে কামনা-বাসনার কথা মনে মনেও প্রকাশ্যে ভাবতে পারি না, চেতনা যাদের অহরহ সেন্সর করে চলে, তারাই তো ভোল বদলে চলে আসে স্বপ্নে! সাররিয়ালিজ্ম মানে তাই বাস্তবতা-বহির্ভূত কোনও পরাবাস্তব নয়। ‘যে খাঁটি মানসিক স্বতঃপ্রণোদনা বারংবার নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, বাইরের কার্যকারণ, নন্দনতাত্ত্বিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণে আটকে থাকতে চায় না, তাই সাররিয়ালিজ্ম।’
চেতন মনের সেই নিয়ন্ত্রণরেখার বাইরে যেতে পেরেছিলেন বলেই মাত্র ২৭ বছর বয়সে, স্প্যানিশ শিল্পী সালভাদর দালি এঁকে ফেলেছিলেন স্মৃতির নাছোড় অধ্যবসায়: ‘পারসিসটেন্স অব মেমরি’। ঘড়িগুলি গলে গলে পিচ্ছিল, কেউই যথাযথ আকৃতিতে নেই। এই পিচ্ছিল অবস্থা যেন মাতৃজঠরে ভ্রূণাবস্থায় থাকার ইঙ্গিত। আমি তো আজকের ঘটনা নিয়েই স্বপ্ন দেখি না, গত কাল, গত পরশু... এমনকী এক বছর, বহু বছর আগের যে ঘটনা ভুলে গিয়েছি, সে হঠাৎ অবচেতনার স্বপ্নে হানা দেয়। ছবির সামনে বড় বড় শুঁয়োয় ঢাকা চোখের পাতা, কোনও এক সমুদ্রদানবের মুখ। নিমীলিত এই দানবিক নেত্রপল্লবও কি স্বপ্ন দেখছে? না কি, এই লম্বা শুঁয়োয় আছে যৌনতার ইঙ্গিত? যে বারংবার মনে করিয়ে দেয়, আমাদের পোকাজীবন! কাফকার গল্পের নায়কের মতো আমরাও তো মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করি, আমরা পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছি। টাইমপিস রাখার কাঠের টেবিলে গজিয়ে উঠেছে নিষ্পত্র ন্যাড়া গাছ, সমুদ্র পেরিয়ে ডান দিকে পাহাড়। বাঁ দিকের অক্ষত টাইমপিসে ঘড়ির কাঁটা নেই, থিকথিকে পিঁপড়ে। কখনও মৃত্যু, কখনও বা নারীর যোনির প্রতীক হিসেবে এই পিঁপড়েরা দালির শিল্পে বারংবার ছবিতে ঘুরেফিরে আসবে। কখনও ঘোড়ার পা হয়ে যাবে পিঁপড়ের মতো। আবার কখনও বুনুয়েলের সঙ্গে তিনি ‘আন্দালুসিয়ান ডগ’ নামে যে ছবি করবেন, সেখানে চোখের মণির দিকে এগিয়ে আসবে ছুরি। হাতের চেটোয় থিকথিক করবে পিঁপড়ে। দালি অবশ্য নিজে ছবিটির কোনও ব্যাখ্যা দেননি। সাররিয়ালিজ্ম তো ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে না। সে বলে, ব্যাখ্যাতীতকে স্পর্শ করার চেষ্টা করো। ব্যাখ্যা দেওয়ার দায় বা ইচ্ছে বা ক্ষমতা থেকে বহু দূরে পালিয়ে, শিল্প করো।
|
|
এর আগে বেশির ভাগ শিল্পই যুক্তিবাদের, পারম্পযের্র কথা বলত। সাররিয়ালিজ্মই প্রথম ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তি ও যুক্তিবাদের পরম্পরা থেকে পুরোপুরি বের করে আনল নিজেকে। তার ম্যানিফেস্টো বলে, ‘মানুষকে ভাষা দেওয়া হয়েছে, যাতে সে, ভাষাকে সাররিয়ালিস্ট ভঙ্গিতে ব্যবহার করতে পারে।’ সাররিয়ালিস্টদের জন্মের আগে ফ্রিডরিখ নিটশে নামে এক জার্মান দার্শনিক খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, ভাষা সাধারণ যুক্তিবাদের প্রতীক, ক্ষমতার প্রতীক। ‘তার চেয়েও অনেক বড়, সবচেয়ে বড় যুক্তি রয়ে যায় শিল্পকলায়’, লিখেছিলেন তিনি। সাররিয়ালিজ্ম যুক্তিবাদের বাইরে স্বপ্নে এবং অ-যৌক্তিকতায় সেই বড় যুক্তিকেই খুঁজে পেতে চায়।
গলে-পড়া নাছোড় স্মৃতিতে ফেরা যাক। এক ক্রিটিক ওই ছবিতে আইনস্টাইনের ‘সময়ের আপেক্ষিকতা’র প্রভাব আছে কি না, জানতে চেয়েছিলেন! দালির সাফ উত্তর ছিল, ‘দূর মশাই, রোদে চিজ রাখলে গলে যায় দেখেননি? সেখান থেকেই আইডিয়াটা এসেছিল।’
স্বপ্নের এত গুরুত্ব কেন? কারণ, সে বাস্তবের চেয়ে কোনও অংশে হীন নয়। ম্যানিফেস্টোয় ফ্রয়েডের পাশাপাশি শেক্সপিয়র, দান্তে, শার্ল বদলেয়র, হুগো, র্যাঁবো, মালার্মে প্রমুখের কথা লিখেছেন ব্রেত। শিল্প যে কল্পনা আর বাস্তবের সংশ্লেষ, সেটাই ওই পূর্বজরা বুঝিয়েছিলেন। অতঃপর ব্রেতঁর আশা, ‘স্বপ্ন আর বাস্তব দুই আপাত-বিরোধিতা মিলেমিশে তৈরি হবে নতুন এক চূড়ান্ত, সুপার-রিয়ালিটি।’ এক জার্মান দার্শনিকের কণ্ঠ কোনও মতে এড়িয়ে যাওয়া গেল না। থিসিস আর অ্যান্টিথিসিস মিলেই তো তৈরি হবে ভবিষ্যতের সিন্থেসিস! ম্যানিফেস্টোই ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে সংঘ ভেঙে যাবে। ব্রেতঁ, লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার নাম লেখাবেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। দালি কোনও দিনই সেখানে যাবেন না।
কমিউনিজ্মের প্রভাবেই ১৯২৯ সালে তৈরি হবে সাররিয়ালিজ্মের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। সেখানে ব্রেতঁ লিখবেন, ‘দ্বন্দ্বমূলক চেতনা নিছক অর্থনীতির ব্যাপার নয়। ভালকে মন্দ থেকে আলাদা করতে, সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করতে এই চেতনা জরুরি।’ নাৎসি জমানায় শিল্পীরা কী ভাবে রুখে দাঁড়াবেন, তার ইঙ্গিত।
সাররিয়ালিজ্ম শুধু ছবি নয়। মনে পড়তে পারে এল্যুয়ারের কবিতা, ‘তোমাকে সমুদ্রের গাছেদের কথা বলেছিলাম/ প্রতি ঢেউয়ে, পাতায় বসা পাখিরা শব্দের নুড়িপাথরকে শোনে।’
কত পাখি কত ভাবেই যে উড়েছে! গালা তখন এল্যুয়ারের স্ত্রী, দালির সঙ্গে জীবন কাটাতে শুরু করলেন। ‘সাররিয়ালিজ্ম মেয়েদের ভালবাসে, তাদের উৎসব হিসাবে দ্যাখে,’ লিখেছিলেন সাররিয়ালিস্টরা। পরের প্রজন্মে এই প্যারিসেই বেরোবে সিমোন দ্য বোভোয়া-র ‘সেকেন্ড সেক্স’। নারীবাদ আর অস্তিত্ববাদের যৌথ ধাক্কায় উড়ে যাবে এই সাররিয়ালিস্ট পৌরুষ।
তবু নারীরা রয়ে যায়। প্রথম ম্যানিফেস্টো বলেছিল, ‘ঘুমন্ত মানুষের মনই সবচেয়ে তুষ্ট। সম্ভাবনার বিষণ্ণতা সেখানে নেই। খুন করো, লুঠপাট করো। যত খুশি ভালবাসাবাসি করো।’
আজও স্বপ্ন লজ্জাহীন! |
|
|
|
|
|