১৯৬৭ সাল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। আমাদের এক কবিদাদা ঠিক করে ফেললেন আর্টস কলেজ ভবনের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে আমরা কেউ কেউ কবিতা পাঠ করব। এই ভাবে বাংলা কবিতার একটা পরিবেশ তৈরি হবে। কবিতামনস্ক হয়ে উঠবেন আমাদের সহপাঠীরা।
কতকটা এই মেজাজেই কি কলকাতার ট্র্যাফিক সিগনালগুলো থেকে রবীন্দ্রনাথের গান বাজানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? আমাদের সেই যাদবপুরের দাদা যেমন ভেবেছিলেন যে বাংলা কবিতার যথেষ্ট চর্চা ছেলেমেয়েদের মধ্যে হচ্ছে না। তাই ‘কানের কাছে নানান সুরে/ নামতা শোনায় একশ’ উড়ে’র ধাঁচে জনা চারেক পোড়ো অজিত দত্ত বা অমিয় চক্রবর্তীর অখ্যাত কিছু কবিতা শোনাতে থাকবে। এটা ঠিক যে, ওই ভবনে ইংরিজি, দর্শন ও অর্থনীতির পড়ুয়ারা অজিত-অমিয় কাব্য সম্পর্কে কতটা অবহিত, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ তবু হয়তো ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান নাগরিক বাঙালি চেনে না বা শোনে না, এমনটি ধরে নেওয়ার কারণ নেই। এমন বাঙালি ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা যথেষ্টরও বেশি দেখেছি, যাঁরা ঘটা করে জানিয়ে দেন যে তাঁরা কেবল রবীন্দ্রসংগীতই শোনেন। অন্য কিছুতে তাঁদের রুচি নেই।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের সময় থেকেই বাঙালি ভদ্রশ্রেণির মধ্যে একটা শুধুরবীন্দ্র শুধুরবীন্দ্র ভাব দেখা দেয়, যা আগে এই মাত্রায় ছিল না। গান গাইতে পারতাম বলে বড়রা গান শোনাতে বলতেন। আত্মীয় থেকে শুরু করে বন্ধুদের বাবা-মা পর্যন্ত সকলেই। বছর পাঁচেক বয়স থেকেই কেউ গান শোনাতে বললে প্রিয় কোনও আধুনিক বাংলা গানই গেয়ে দিতাম। মনে আছে, ১৯৫৭ সাল, আমার বয়স তখন আট, পাড়ায় ‘রঘুডাকাত’ নাটক হচ্ছে। নাটকের আগে একটা গান হবে। বড়রা ঠিক করলেন আমি গাইব। আমার বাবা-মা এঁদের মধ্যে ছিলেন না। বড়রা বললেন রবীন্দ্রনাথের গান। আমি বেঁকে বসলাম। আমার পছন্দ তখন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘তুমি কতদূর কোথায় ব’সে/ মালা গেঁথে যাও মনহরষে’। বড়দের মধ্যে কেউ কেউ আপত্তি তুললেন। বললেন, কী পাকা-পাকা কথা। ওইটুকু ছেলের মুখে মানায়? আমি মানলাম না, আমার সমবয়সি বন্ধুরাও মানল না। রেডিয়োয় শোনা ওই গানটাই হবে। কী সুর, কী ছন্দ! শুনলেই আনন্দ হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা অকারণে চঞ্চল’ গাইতে গেলে ‘অকারণে’র পরেই ‘এ’ বলে একটা খোঁচা দিতে হয়। হাসি পেয়ে যায়। ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’র ‘মরি হায় হায় হায়’ গাওয়াই যায় না, এত বোকা-বোকা লাগে কথাগুলো। নবীনদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেন বড়রা। ওটাই যদি ১৯৬১ সালের পর হত তো বড়রা মেনে নিতেন কি না, সন্দেহ। তাঁদের রবীন্দ্রভক্তির স্টিমরোলারটা তাঁরা আমাদের ওপর চালিয়ে দিতেনই দিতেন। |
কৈশোর পর্যন্ত একটা কথা বেরসিক বড়দের মুখে মাঝেমাঝেই শুনতাম: রবীন্দ্রনাথ নাকি পঙ্কজ কুমার মল্লিককে বলেছিলেন আমার গানের ওপর তুমি স্টিমরোলার চালিয়ো না। যাঁরা এটা জানিয়ে দিতেন, খেয়াল করে দেখতাম রবীন্দ্রনাথের ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি’ আর ‘ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি’ গোছের একঘেয়ে সুরওলা গানগুলোই তাঁরা পছন্দ করতেন। ‘আজি বরিষণ মুখরিত’র মতো একটি চমৎকার সুরবৈচিত্রসংবলিত, সুঠাম স্মার্ট গানের কথা তাঁদের কখনও বলতে শুনিনি। স্টিমরোলার যদি কেউ চালিয়েই থাকে তো সেটা বাংলার ভদ্রলোকশ্রেণির কেষ্টবিষ্টুরা। এবং সেটা তাদের সংগীতরসহীন, কর্তাভজা, রবীন্দ্রসংগীতপুজোর স্টিমরোলার। এটা তারা এক দিকে চালিয়েছে আমাদের সকলের ওপর, আর অন্য দিকে খোদ রবীন্দ্রনাথের গানের ওপরেও। ছোটবেলা থেকে এও দেখে এসেছি যে, বাংলা গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে পত্রপত্রিকায় মন্তব্য করেন কবিসাহিত্যিকরা। এও এক আজব ব্যাপার। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ বা সুধীন দাশগুপ্তর অভিমত সাংবাদিকরা নিতেন না। যেন রবীন্দ্র, দ্বিজেন্দ্র, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ বিশেষ করে এই গীতিকার-সুরকারদের গানগুলো আসলে সাহিত্য।
এক জন মানুষ একটানা অত গান বেঁধে গেলে কিছু গান, হয়তো বেশ কিছু গান, সুরবৈচিত্র আর আবেদনের দিক দিয়ে একই রকম শোনাবে, একটা ম্যাড়মেড়ে ভাব জাগাবে। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতসর্বস্বদের হুঁশ নেই সে দিকে। সংগীত, সুর তাঁদের কিছু বলে না। রবীন্দ্রনাথ হলেই হল। রবীন্দ্রসংগীত নামটাই যথেষ্ট। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো, কোনও প্রশ্ন না তুলে, কথা না বলে, দু’চোখ বুজে বা শিবনেত্র হয়ে থাকো। এ যেন সকলে দাঁড়িয়ে উঠে এক মিনিট নীরব থেকে কোনও মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। ওই এক মিনিটে কে কী ভাবছে যদি জানা যেত! নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধা? ভালবাসা?
আমাদের ছাত্রজীবনের সেই ‘অপারেশন বাংলা কবিতা’র মন্ত্রদাতা দাদাটি কিন্তু কবিতা ভালবেসেই যা করার করেছিলেন। সিঁড়ির এক দিকে ছেলেরা কবিতা পড়ছেন। সহপাঠীদের নাকের ডগায়। ইচ্ছে হলে কেউ শুনছেন। ফলে সিঁড়ি আটকে যাচ্ছে। কারুর একটু বিরক্তি। কারুর বা: মন্দ-কী? ‘প্যাঁচ কিছু জানা আছে কুস্তির?’ বাঃ, বেশ তো? এই গৌতম, কার লেখা রে? পাঠ থামিয়ে তরুণ কবি ও কবিতাপ্রেমী বলে দিলেন। সব মিলিয়ে যৌবনের এক তা-বেশ-তা-বেশ মজা।
ট্র্যাফিক সিগনাল থেকে রবীন্দ্রসংগীত বা যে-কোনও সংগীত যদি নির্গত হয়, সেটা মজা থাকে না। আর, গানবাজনাকে ভালবাসলে কেউ অমন নিষ্ঠুর-নৈর্ব্যক্তিক ভাবে রাস্তার মোড়ে লাউডস্পিকারের সাহায্যে সংগীত ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না। জীবনে কয়েকবার দেখেছি শ্মশানযাত্রীরা হরিধ্বনি দিচ্ছেন আর ঠোঙা থেকে খই ছড়িয়ে দিচ্ছেন রাস্তায়। বুভুক্ষুদের দেশে উপযুক্ত রীতিই বটে। তবু, সেই খই কোনও মানুষকে খুঁটে তুলে খেতে দেখিনি। আমার বিশ্বাস, পেটে সূর্যের মতো খিদে নিয়েও সকলে তাঁদের রুচিটা পুরোপুরি বিসর্জন দেন না। সত্তায় যাঁর বাস্তবিকই সংগীতের ক্ষুধা, তাঁর মেনে নিতে কষ্ট হবে যে, কলকাতার রাস্তার মোড়ের পরিবেশে ট্র্যাফিক সিগনাল থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি বেরিয়ে আসছে চিঁ-চিঁ করে। শুনছে ক’জন? রাস্তায় ছড়ানো খই তবু কাকে খায়। কাক কি গান শোনে?
গাড়ির সংখ্যা কলকাতার রাস্তায় রোজ বেড়েই চলেছে। একই তালে বেড়ে চলেছে গাড়ির হর্নের নিনাদ। তারই মধ্যে ট্র্যাফিক সিগনাল থেকে ভরদুপুরে নেমে আসছে রাতের রাগের মেজাজমাখানো রবীন্দ্রনাথের গান ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ অথবা ইমনে বাঁধা ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে’। যাঁর মস্তিষ্ক থেকে এই পরিকল্পনা বেরিয়েছে, গানবাজনার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা আছে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রসংগীতকে মানুষের আরও
কাছে নিয়ে যাওয়ার বাসনা যদি তাঁর হয়ে থাকে, তা হলে গান শোনার উপযুক্ত পরিবেশ নিয়েও তো তাঁর ভাবার কথা।
অবশ্য ভারতের রাজনীতিকরা হয়তো সংগীতকে এখন দেখছেনই অন্য মন নিয়ে। বছর আড়াই আগে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ইউ পি এ সরকারের সাংসদদের তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন রাতের ভোজে আপ্যায়িত করবেন বলে। সন্ধেবেলা অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে গিয়ে দেখি চমৎকার সামিয়ানার নীচে ঢালাও আয়োজন। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ছিল। নেপথ্যে বাজছিল সেতারে সারঙ্গ অঙ্কের কোনও একটি রাগ। সকালের রাগ সন্ধ্যাবেলা। এই থিসিসের পর অ্যান্টিথিসিস: কলকাতার ট্র্যাফিক সিগনাল থেকে বেরিয়ে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান রাতের রাগ সকালে, দুপুরে।
সিন্থেসিস: রবীন্দ্রনাথেরই একটি গানের লাইন একটু পাল্টে: ‘এখন আমায় নাই বা মনে রাখলে’। |