রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
খুনি ধর্ম
তেই যথেষ্ট শরীর ঘুলিয়ে ওঠে, ধ্বক করে ওঠে বুক যে নষ্ট ভ্রূণ অস্ত্রোপচার করে বের না করায় গর্ভিণী নারীটি মরে গেল রক্ত বিষিয়ে! চিকিৎসা-বিভ্রাট হলে তদন্ত কমিশন বসানো যায়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-উত্তর চব্বিশ পরগণার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবহেলা হলে চিকিৎসকদের পিটিয়ে যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করা যায়। কিন্তু জায়গা যখন আয়ারল্যান্ড, তখন বিষয়টি ভিন্ন। তৃতীয় বিশ্বের আমরা। গর্ভপাতের হাজার ঢাক-গুড়-গুড় বৈধ-অবৈধ ক্লিনিক। সেখানে সবুজ অয়েল ক্লথের ওপর খালাস হতে গিয়ে দিবারাত্র মেয়েরা মরছে, নয়তো জন্মের মতো রোগগ্রস্ত হয়ে ফিরছে এইটা জেনে যাদের অভ্যেস, তারা অবধি অবাক মানি যে ক্যাথলিক চার্চমতে ভ্রূণহত্যা-গর্ভপাত পাপ বলে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপরও চলে এই খবরদারি: যাতে নষ্ট রক্তের পুঁটলির মধ্যে প্রাণের স্পন্দন রাখতে গিয়ে জলজ্যান্ত গর্ভিণীর হৃৎস্পন্দনের কী হবে, এই তোয়াক্কা থাকে না। এমনকী, গর্ভবতী মায়ের প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজনেও অ্যাবর্শন হবে কি না, সে-সিদ্ধান্ত নেয় না, ডাক্তাররা নয়, ধর্মীয় যাজকেরা।
প্রতিটি ধমের্র আছে ভাল থাকার, শুভর আশ্বাস। এমনকী জন্মায়নি যা, যা অনাগত এবং যারা চলে গেছে, যেন তাদের জন্য মধুবাতা ঋতায়তে হয়, বায়ু নির্মল, জল শুদ্ধ হয়। আমাদের ভাবতে ভাল লাগে যে, এই যে প্রদীপগুলি আমরা ভাসাই গঙ্গায়, তা ঘুরে ঘুরে জলের খর ঠান্ডা স্রোতে কোথায় পাক খেয়ে চলে যায় আমরা জানি। সকলে সুখী হোক কথাটি বলবার মধ্যে যে সৌন্দর্য, তা-ও ধর্ম। কিন্তু ঘটনা হল, কিছু কিছু গোঁড়া বিগ্রহ কিন্তু কোনও বেনিয়মি বেআক্কিলে উপাসককে চান না। তাঁদের পূজার প্রবেশদ্বার নিয়মের নৈকট্য মেনে নিশ্ছিদ্র বন্ধ। যে ধর্ম সমাজকে প্রয়োজনীয় স্থিতাবস্থা দিয়েছে, সেই ধর্মই আবার ‘এটাই স্থিতাবস্থা’ বলে এমন নিগড়ে শেকলে বাঁধে যে, বাঁধাটাই বড় হয়ে পড়ে, নির্মম দাঁত-মেলে-দেওয়া, নখ-ছিরকুটি হয়ে পড়ে, ভাল থাকাটা নয়। এই-ই ঠিক, এ ভাবেই ভাল থাকতে হবে ঘোষণা করে টুঁটি-টেপা যে ধর্মীয় নিয়ম, তা একা-মানুষের ব্যক্তিগত থাকা ও সকলের সঙ্গে থাকা, দু’ক্ষেত্রের মানবাধিকারই বারবার খর্ব ও ক্ষুণ্ণ করে।
ধর্মের এই ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত ও প্রয়োজনে অতীব সংহত রূপ, যা ধর্মের অন্য কোনও রূপকে, বেঁচে থাকার ভিন্ন জ্ঞান ও তরিকাকে গ্রাহ্য করে না, সেইটা তার প্রাতিষ্ঠানিকতা। তখন সেটা ধর্মমত হিসেবে খাতায় লেখা নিদান, তা সব চাইতে ভাল ভাবে মানবার জন্য একের পর এক টীকা, অন্য কোনও মতামতকে অগ্রাহ্য করার কুৎসিত আগ্রাসী ঔদ্ধত্য। যে কোনও ধর্মমতের প্রাথমিক শর্তই অন্যের ভাল নিয়ে ভাবতে বলে, স্ব-কে ছেড়ে উপাসনায় মন দিতে বলে, ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর সামনে তুলে দিতে বলে নিজ মুখের গ্রাস। কিন্তু, উপাসনা যদি হয়ে দাঁড়ায় মিলিটারি কুচকাওয়াজের শামিল, তখন, সেখানে শামিল নয় যারা, তাদের যে ঠিক ঈশ্বর নেই এটাও বকলমে তৈরি হয়ে যায়। কারণ ঈশ্বরকে ওখানে ওই উপাসনায় ওই মুহূর্তে উহারাই পাইবে। অন্য কোথাও নয়। আর কেউ নয়। ফলে সেই ধর্মের মধ্যেও যদি ঘাস-বিচালি না করে অন্য তালে পা ফেলে কেউ, তাদেরকে ধর্মদ্বেষী-কাফের-পেগান-বিধর্মী নানা নামে ডেকে অত্যাচার করা হয় যত ক্ষণ না সে চুপ করে যায় বা ঘাস-বিচালিই বলে ওঠে শেষ পর্যন্ত।
‘দ্য প্যাশন অব জোন অব আর্ক’ ছবির এক স্থিরচিত্র।
পারস্যে নবম শতাব্দীতে সুফিসন্ত মনসুর আল-হাল্লাজ বলেছিলেন, আমিই সত্য। সুফিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ঈশ্বরকে কী কী ভাবে পাওয়া যেতে পারে এই নিয়ে যে জ্ঞান, তাকে জটিল ও বিমূর্ত না রেখে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জ্ঞান তো সকলের কাছে গেলে বিপদ, বিশেষত যে জ্ঞানে বলা হচ্ছে তোমার জোব্বার ভিতরে যে বাস করে, ঈশ্বর সে-ই। আর তুমি বনবন পাক খেয়ে, ঝিম-ধরানো গান গেয়ে, ঈশ্বরকে সেই প্রেমিক ভেবে শারীরিক আবেদনময় ভাষা ব্যবহার করতে পারো। এই বিধর্মিতার দাম চোকাতে হয় বাগদাদের চক-এ, যেখানে চকচকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁটিতে বাঁধা মনসুরের হাত, পা, অন্যান্য অঙ্গ ও শেষে জিভ একটু একটু করে ছেদ করা হয় জ্যান্তে, পুড়িয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় ছাই। আবার সুফিবাদের মধ্যে থাকে ঠিক-ভুল, রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা ও সমাজের প্রান্তের দিকের ধর্মাচরণ এই দুইয়ের মধ্যে বিভেদ। শরিয়া মেনে চলায় আগ্রহী সুফিরা আবার কদাচ মানতে আগ্রহী নন যে, সূক্ষ্ম দার্শনিক মারফতি তত্ত্বের উল্টো দিকে পদ বেঁধে উন্মত্তপ্রায় নাচাগানা করে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। এই বেশরম বেশরা সুফিরা প্রচলিত জ্ঞানের ধার না ধারার ফলে হয়ে ওঠেন আতঙ্কের, ধর্ম নামক যে প্রতিষ্ঠান, তার অনুপযুক্ত। ইসলাম-অনুগ সুফিরা এদের কুনজরে দেখবেন, ‘কলির ফকিরের খেলা ও আলিমগণের নছিহত’ বইতে শ্রী আব্বাছ আলি নাজির ১৯২০ সালে এদের গঞ্জনা দেবেন এই বলে যে এদের উপাসনায় শয়তান সরমিন্দা (লজ্জিত) হয়, কেন না, এরা ‘সারা দিন গাঞ্জা খায় সকলে বসিয়া/ রাত্রে যায় পীরের বাড়ি জরু সঙ্গে লিয়া’, যেখানে ‘মধ্যে নাচে বামাগণ খেমটাওয়ালির মত’। শরীর, তাতে ধরা পড়া যে অতিরিক্ত, তা ভয়ের।
ধর্ম যখন প্রতিষ্ঠান, তখন ধর্মের মধ্যে ভিন্নতাকে সে ক্ষালন করার চেষ্টা করে হয় হিংস্র ভাবে মুছে, নয়তো অপপ্রচার করে। বেশরা সুফিদের মতো, তান্ত্রিক সহজিয়া বৌদ্ধদের জ্ঞান ও চর্যা উভয়কে ধর্মীয় সামাজিকতার ও রাষ্ট্রের চলনের বিরোধী বলে ভাবা হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য সেন আমলে ন্যাড়া বৌদ্ধ সহজিয়া পালাতে পালাতে অসামের কদলীবনে উপস্থিত হননি? যেন প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ডে লেখা হয় চর্যাপদ ও অপরাপর সহজিয়া ধর্মীয় তত্ত্ব, হেঁয়ালির ভাষায়, যাতে প্রতিষ্ঠান বুঝতে না পারে সন্ধ্যাভাষা। বুঝতে না পারলে তো পোড়ানোর প্রশ্ন নেই। তত্ত্ব টিকে যায় তার ফলে, কিন্তু তা সাধারণ সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যায়। এমনকী ‘তৃণাদপি সুনীচ’ নিত্যানন্দ মহাপ্রভু জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক জন ঘরছাড়া ন্যাড়া বৌদ্ধ জটলা করছে দেখে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত’-এ খড়ম খুলে পেটাননি? (বৃন্দাবনদাস-বিরচিত, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৫, পৃঃ ৫০) আর নিম্নবর্গীয়দের অবস্থা দেখুন। নিত্যানন্দ এক, ওরা কয়েক জন। উল্টে প্রহার না করে পালাল তারা, যা প্রমাণ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠান হিসেবেও অভূতপূর্ব সাফল্য, যা ধর্মের অন্যান্য পথকে চেপে দেওয়ার প্রয়াসও নেয়। বাংলার বৌদ্ধমূর্তিগুলি, ব্রাহ্মণ্য আমলে, চালিয়ে দেওয়া হয়নি, বিষ্ণুমূর্তি বলে-টলে?
ধর্ম কী, ধর্মীয় সত্যই বা কী, কোন পথে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে, তুই ভুল আমি ঠিক, কারণ দ্যাখ আমি তত্ত্বটা এ ভাবে বুঝি আর এ হেন যুক্তিতে পর পর সাজিয়েছি, নে এ বার তুই তোর দান দে এতে একটা ধর্মের মধ্যে ও বিভিন্ন ধর্মে দর্শনে জ্ঞানে আলোচনার পথ খুলে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা তো এ রকম তকরার-এর স্তরে থাকে না। ‘আমিই এক মাত্র সত্য’ যখন বলতে চায় ধর্ম, তখন অন্যের অন্য জ্ঞান-ঈশ্বরচিন্তা-সমাজবোধ সবটুকুই থেঁতলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। তাই রোমান ক্যাথলিক গির্জা ইনকুইজিশনের সময়ে করতে থাকে এত ব্যাপক ধরপাকড়। ভিন্ন মত বললেই টুঁটি টিপে ধরে, কাঠের খাম্বায় বেঁধে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হত। ১৪০০ থেকে ১৮০০ সাল অবধি ইউরোপের প্রায় সর্বত্র চলে এই অবিশ্বাস-ভয়-পাপবোধ-নির্যাতন। অখ্রিস্টীয় যে ধর্মবোধ, শরীরী ও মন্ত্রনির্ভর, তাকে জাদুটোনা ও অশুভ আত্মা ও শয়তানের সঙ্গে এক করে দেখে, ডাইনি সন্দেহে ও ডাইনি বলে অত্যাচার করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে হাজার হাজার নারীকে। ইউরোপের প্রতিটি কোনা-কানাচিতে। আমেরিকায়-কানাডায়-লাতিন আমেরিকায় ও যেখানেই ক্যাথলিক গির্জা আছে!
কারণ ধর্মচর্চা বলতে একটা রকমই থাকবে। অন্য রকমগুলি নয়। অন্য রকমগুলি ধর্ম-আচার হতে পারে, জ্ঞান-দর্শন-বিজ্ঞানও হতে পারে। যদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণায় বদল ঘটলে, নতুন আবিষ্কার হলে, ধর্মতত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই নড়ে যায়, দাও ভিলেনটাকে ধরে তার বিজ্ঞানটা গিলিয়ে। মানুষ ঈশ্বরের সন্তান, তাই ঈশ্বর তার বাসস্থানকে গড়েছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে, সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা বাঁইবাঁই করে পাক খাচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে। একে উল্টে যদি গালিলেয়ো প্রমাণ করে দেন কোপারনিকাসের তত্ত্ব যে, সূর্য স্থির এবং কেন্দ্র, তখন কোথায় যায় রোমান ক্যাথলিকের পায়ের তলার মাটি? কারণ তখন যা যা তার প্রতিষ্ঠানের মূল ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সব কিছু ফিরে লিখতে হয়। আর ধর্ম তো বদলাতে পারে না নিজেকে। কারণ তা এক ক্ষণজন্মে উদ্ভূত প্রকাশিত (revealed) সত্য। তার ব্যত্যয় ঘটলে ধর্মের সংজ্ঞাটাই বদলে যায়। তাই গালিলেয়োকে কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার পর, ৩৬০ বছর লাগে অন্য কথা মানতে। ১৯৯৩ সালে ভ্যাটিকান মেনে নেয় যে হ্যাঁ, পৃথিবী নয়, সূর্যই স্থির ও তাকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরছে গ্রহতারকাচন্দ্রপৃথিবী। এই ভ্যাটিকান ১৯৫০ সালে, অতি ক্লেশ সয়ে মেনে নিয়েছে বিবর্তনের ডারউইনীয় তত্ত্ব যে অমৃতস্য পুত্রাঃ বাঁদর-গোত্রভুক্ত এবং কুঁজো উলঙ্গ রোমশ কদাকার প্রাণী থেকেই মানবের উৎপত্তি।
দাঁড়ান দাঁড়ান। চট করে নিজেকে খুব সহনশীল, নতুন চিন্তার দিকে ডিঙ্গিপাড়ি দিতে উদ্গ্রীব ভেবে মুচকি আত্মতৃপ্তির দিকে যাবেন না। ভ্যাটিকান কী বলছে, তার সঙ্গে ম্যাঙ্গালোরের রোজারিয়ো পরিবার কিংবা বো ব্যারাকের ক্যাথি কী ভাবছে তার সম্পর্ক নেই কিন্তু। ধর্ম ও সেই ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরা ধর্মীয় নিদান সম্পর্কে সহমত না হতেই পারেন। তাই ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানকে গুলিয়ে ফেলবেন না। আমরা ধর্ম বলতে এমন একটা ব্যবস্থার কথা আলোচনা করছি যেখানে অন্য কোনও পরিপ্রেক্ষিত থেকে ধর্মের মূল সূত্রগুলি পড়ার চেষ্টা করলে, সেই ব্যবস্থা থেকে শ্বাসরোধ করে দেওয়া হয়। চিরটা কালই যেটা হয়ে এসেছে, নানা ব্যবস্থার মধ্যে, বিশেষ এক ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য, সত্যের একখানা মুখ রেখে বাকি মুখগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। মনুস্মৃতি যেমন শূদ্র ও নারীকে সমস্ত সামাজিক জ্ঞানের বাইরে পদানত রাখার জন্য সংস্কৃতের অধিকারই দেয়নি। কেননা পড়তে পারলেই না প্রমাণ সম্ভব যে ধর্মীয় তত্ত্ব আকাশ থেকে পড়া এক ধরনের হৃদয়ে মননে উদ্ভাসিত সত্য নয়, সমাজের বিশেষ একটা কালে বিশেষ প্রয়োজনে তৈরি একটা জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবদান বদলায়, ফুরায়, মজে হেজে যায়। আর সেই ধর্মীয় জ্ঞানের আছে খুব সুনির্দিষ্ট সামাজিকতা। তখন তা যদি গোঁড়া সমাজের পরতে পরতে ধর্মীয় গুরুকে দিয়ে প্রচারিত ও জ্যান্ত থাকে তা হলে আজও অন্য রকম হলেই, আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটলে, বেকায়দা এক পা ফেললেই, মাথা ন্যাড়া, ঢিল ছুড়ে বা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা চলবে। হিজাব সরে মুখ দেখা যাওয়ায়, পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় জ্যান্ত পুড়ন্ত লাশগুলিতে এখনও ভর্তি না ইউ-টিউব? জনগণের আলোচনার জন্য এই একটা প্রশ্ন অবধি ছুড়ে দেওয়া যাবে না যে বাল ঠাকরের মৃত্যুতে কেন দিনের পর দিন জনজীবন বাধ্যতামূলক স্তব্ধ হয়ে থাকবে।
তাই খুশি হয়ে উঠবেন না এমন বোকা কথা ভেবে: ‘ওদের’ ধর্ম হিংস্র। ওরাই প্রতিস্পর্ধী স্বর, ব্যক্তিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর, স্তব্ধ করে দেয়। ওদের ধর্মকে ওরা অনড় অচল রেখে দিয়েছে তাই ওদেরই আছে রুশদি, তসলিমা। ভুলবেন না, আমাদেরও জ্বলজ্বল করছে গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইন্স আর তাঁর বাচ্চাদের পুড়িয়ে মারার পর দারা সিংহ-র তৃপ্ত গর্জন! আসলে দু’ধরনের ধর্মের মধ্যে সূক্ষ্ম ফারাক, নিট ফল একই। যাদের আরবিতে ধিম্মি বলে, অর্থাৎ গ্রন্থনির্ভর ধর্ম যেগুলি, তারা ওই গ্রন্থকারণে বহু নিদান হাঁকড়াতে পারে। আর ওই গ্রন্থনির্ভর বলেই সেই গ্রন্থের আওতা থেকে বেরিয়ে আয়ারল্যান্ডের হাসপাতালের একটি প্রাণী সবিতার অসুস্থতার সময় প্রশ্ন তুলল না যাতে বিজ্ঞান ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে কথা বলতে পারে! ওদের দেশে কি গর্ভপাত করার পরিস্থিতি নারীদের জীবনে আসে না? না কি গর্ভপাতের অধিকার পেতে নারীবাদী যে আন্দোলন সে যেখানেই ছড়িয়ে পড়ুক এশিয়া আফ্রিকায়, আয়ারল্যান্ডকে স্পর্শ করেনি! এখন অবশ্য প্রচণ্ড প্রতিবাদ হচ্ছে, তবু মনে হয়, ক্যাথলিক দেশগুলি কেন এই বিতর্কে ফুঁসে ফুলে ফেটে পড়ছে না যে একটা স্থিত ব্যবস্থা কখনওই কিছুতেই চলমান সমাজের ও ব্যক্তির বহুমাত্রিক প্রয়োজন মেটাতে পারে না, যদি না সেটা সমসাময়িক সাম্প্রতিক হয়ে ওঠে? সাধে ২০০৯-এ ভ্যাটিকানের সিক্রেট আর্কাইভ্স-এর তিতিবিরক্ত প্রধান বলে ওঠেন, এ বার সময় এসেছে বিজ্ঞান ও ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যে দূরত্ব মেটানোর। স্টেম সেল গবেষণা বা ইচ্ছেমৃত্যু বিষয়ে ভ্যাটিকানের গোঁড়ামি কমানো দরকার।
হিন্দুদের ধর্মে গ্রন্থের ধরাকাট নেই, কিন্তু ভুলে যাবেন না, অন্য জাতে বিয়ে করায়, অন্য ধর্মে বিয়ে করায়, পরিবার যখন মেয়েটিকে খুন করে বা পঞ্চায়েত যখন হত্যা করে যুগলকে, তখন না লাগে কোনও শাস্তর না লাগে মক্কা-ভ্যাটিকান। রাজপুত ঠাকুর দলিত বস্তিতে আগুন লাগালে, দলিত মেয়ে বাগানের আম চুরি করে ফেললে তাকে বিবস্ত্র করে ঘোরালে, স্রেফ ‘বেশ করব’ ভেবে দলিত মেয়েকে গণধর্ষণ করলে আর একটা কথা স্পষ্ট হয়। ধর্ম প্রতিষ্ঠান হলে যেমন হিংস্র, তেমনই আচার-বিচার সামাজিকতা হিসেবেও সমধিক হিংস্রতা দেখাতে পারে। ধর্মব্যবস্থা ও ধর্মীয় সামাজিকতা তখনই টুঁটি টিপে স্বাতন্ত্র্য পিষে মারে যখন তাকে ওই মর্যাদাটা দেওয়া হয়। আয়ারল্যান্ড-আফগানিস্তান না হয় ধর্ম-চিহ্নে চিহ্নিত সমাজ ও রাষ্ট্র। এই যে অনবরত ভোট সুরক্ষার জন্য সামাজিক গোষ্ঠীর বদলে একটি সম্প্রদায়কে ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি, তা কি ওই গোষ্ঠীকে ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানের নিগড়গুলি ভাঙার ক্ষমতা দেবে? না কি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পকেটে পকেটে তৈরি হবে এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্মভিত্তিক নিদান বিশ্বাসী বেঁচে থাকা বাড়বে? আর বাড়বে আগুন, তরবারি, কোমল হাতে পোঁতার নিষ্ঠুর পেরেক, নম্র মাথায় পরাবার কাঁটার মুকুট?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.