পুরস্কার
সৃজার খুব শখ দিদিমণি হয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াবে। তাই ক্লাস টেনে ওঠার পর স্কুলে যেই সোসাল ওয়ার্কের প্রজেক্টের সময় এল, সৃজা ঘোষণা করে দিল যে কয়েক জন বাচ্চাকে সে পড়াশোনা শেখাবে।
মা আপত্তি জানালেন, ‘এটা তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। তিন মাস তুমি অন্যের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সেই সময় তোমার পড়াটা করবে কে?’
সৃজা মাকে কথা দিল ‘প্লিজ মা, দেখো আমি নিজের পড়ার একটুও ক্ষতি করব না, বিকেলে গল্পের বই আর সন্ধেবেলায় টিভি দেখা বন্ধ করলেই সময় বেরিয়ে আসবে। আমাদের ক্লাসের রিয়া, পাপড়ি আর মৌ-ও তো সঙ্গে থাকবে!’
ছয় থেকে দশ বছর বয়সের পনেরোটা বাচ্চা জোগাড় হল। ঠিক হল স্কুল ছুটির পর স্কুলেরই একটা ঘরে ওরা ঘণ্টা দুয়েক বাচ্চাদের বাংলা, ইংরেজি আর অঙ্ক শেখাবে। ক্লাসের বন্ধুরা চাঁদা তুলে কিছু বইপত্র, খাতা-পেনসিলও কিনে দিল।
হইহই করে শুরু হয়ে গেল সৃজাদের প্রজেক্ট। বয়স অনুসারে বাচ্চাদের চারটে দলে ভাগ করে ওরা পড়ায়, অক্ষর পরিচয়, গুনতে শেখা, একটু বড়দের জন্য সহজ যোগ-বিয়োগ, নামতা। নিয়ম করে শেখায় ছড়া। গল্প বলে মজার মজার। তবু এক মাস পরে দেখা গেল পড়ানোটা মোটেই সহজ হচ্ছে না। বাচ্চাদের পড়াশোনায় মন নেই মোটেই। একেবারে ছোটগুলো ওদের সঙ্গে মুখে মুখে ছড়া বলে, গল্প শুনে হাসে, কিন্তু অক্ষর চেনাতে গেলেই বলে, ‘দিদি জল খাব’, কেউ বলে ‘পেট ব্যাথা করছে’। একটু বড়গুলোকে নিয়ে সমস্যা আরও বেশি। এরা নিজেরাও পড়তে চায় না, ছোটগুলোকেও কুবুদ্ধি জোগায়।
দলের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার নাম বিলু। বয়স দশের একটু বেশিই হবে। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছিল, এখন সকালে একটা চায়ের দোকানে কাজ করে। যা শিখেছিল একটু একটু মনে আছে। কিন্তু আর কিচ্ছু শিখতে চায় না, এমনকী ছড়াও বলতে চায় না। সৃজারা ওকে ভাল মুখে বুঝিয়েছে, বকেছে, কিছুতেই কিছু হয়নি।
ছবি: সুমন চৌধুরী
‘তোর এই ছড়াটা ভাল লাগছে না? অন্য ছড়া বলবি?’
বিলু চটপট উত্তর দেয়, ‘ছড়া শিখে কি রোজগার হয় দিদি?’ মৌ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘ভাল করে রোজগার করতে গেলেও তো লেখাপড়া শিখতে হয়, ছড়া না বলিস, হাতের লেখা, অঙ্কটা মন দিয়ে শেখ!’
হাসে বিলু, ‘তিন মাসে কি আর লেখাপড়া হয় দিদি?’ ওরা চুপ করে যায়।
এক দিন সৃজারা ঘরে ঢুকেই দেখল সব বাচ্চারা মুখ টিপে হাসছে। ওরা পড়াতে শুরু করতেই শুরু হল উৎপাত, কেউ পড়া বলছে না। বই নিয়ে লোফালুফি, পেনসিল ধরে হিজিবিজি কাটছে। এক পাশে বসে বিলু হাসছে মিটিমিটি। কোনও রকমে ক্লাস শেষ করে সে দিন বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে দিল ওরা।
বাড়ি ফিরে নিজের টেবিলে বসে কাঁদছিল সৃজা; শুধু তো প্রজেক্ট নয়, ও সত্যিই পড়াতে চেয়েছিল, তা হলে! সবাই ওদের কত উৎসাহ দিয়েছে, তাদের কাছেই বা মুখ দেখাবে কী করে!
চোখ মুছে সৃজা দেখল ভাই সৃঞ্জয় ওর সামনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সৃঞ্জয় বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলল, ‘কী হয়েছে রে দিদি, এনি প্রবলেম?’ ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিলুর মুখটা মনে পড়ল সৃজার, প্রায় একই বয়সী তো ওরা দু’জন। কিন্তু এই দুরন্ত ভাইকে কত দিন পড়িয়েছে সৃজা, আর ভাইয়ের বয়সের অন্য একটা বাচ্চার কাছে হেরে যাবে? হঠাৎ ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। চোখ মুছে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ও বলল, ‘নাঃ, সব ঠিক আছে।’
পরের দিন বাচ্চারা ক্লাসে এসে জানল আজ ওদের সব বিষয়ের পরীক্ষা হবে, যারা ভাল করবে তারা প্রাইজ পাবে। বাচ্চারা খুব খুশি। দিদিরা একে একে সবাইকে পড়া ধরল, যে যতটা শিখেছে। বিলু যথারীতি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিল না। পরীক্ষার ফলাফল টুনু নির্ভুল নামতা বলেছে, সোমার হাতের লেখা সবচেয়ে ভাল, কাকলি ঠিক বানান লিখেছে সবচেয়ে বেশি, সকলের চেয়ে ছোট পিন্টু অ থেকে ঔ পর্যন্ত ঠিক বলেছে। সবাই কিছু না কিছু প্রাইজ পেল, ছবির বই, ডটপেন, রংপেনসিল এই সব। আর পেল প্রচুর হাততালি। শুধু বিলু কোনও পড়া দেয়নি, সবাই জানে ও কিছু পাবে না। কিন্তু না, ওই তো বিলুর নামও ডাকা হচ্ছে, সৃজাদিদি বলছে সবচেয়ে বেশি দিন ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য প্রাইজ পাবে বিলু। সত্যিই তাই, যত দুষ্টুমিই করুক, বিলু এক দিনও কামাই করেনি। বিলুর হাতে একটা টুকটুকে লাল ছোট্ট ডায়েরি আর একটা পেনসিল তুলে দিয়ে সৃজা বলল, ‘পরের বার কিন্তু পড়াতেও প্রাইজ পেতে হবে। এই ডায়েরিতে রোজ লিখবি কী কী পড়লি।’ বিলু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, চোখে চিকচিক করছে জল, ও এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে ধমক-গালাগাল বা দু’চার টাকা মজুরির বাইরেও কোনও সুন্দর জিনিস ও পেতে পারে। এই প্রথম ও জানল পুরস্কার কাকে বলে।
এর পর থেকে বিলুকে আর কোনও দিন পড়া নিয়ে কিছু বলতে হয়নি। ডায়েরি আর পেনসিলটা ও খুব যত্নে রেখেছে। কেউ যদি মজা করেও বলে ‘ডায়েরিটা আমাকে দিয়ে দে বিলু, ওর আর কত দাম হবে, পনেরো-কুড়ি টাকা, আমি না হয় তোকে কুড়ি টাকা দিচ্ছি।’ বিলু ফোঁস করে ওঠে বলে, ‘ইইইস, ওটা আমি প্রাইজ পেয়েছি না!’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.