প্রবন্ধ...
এক টানেতে
ল্কেতে প্রথম দু’ তিনটে টানের পরই মাথাটা বেশ হাল্কা লাগে, জিভ শুকিয়ে আসে, বুক আর পেটের খোঁদলটা যেন ভরাট হয়ে যায়। দুনিয়ায় কত লোকেই তো ‘চাকরি হবে’, ‘উন্নয়ন হবে’ ইত্যাদি গ্যাস খেয়ে বুক ভরায়, তা হলে আর গাঁজার বদনাম কেন?
কল্কে ধরা প্র্যাকটিস করতে হয়! দশ আঙুলের ফাঁকে, কল্কের গোড়ায় জড়ানো ন্যাকড়ায় কী ভাবে ঠোঁটটা লাগাব? অসতর্ক হলেই ছ্যাঁকা! অনেকে সিগারেটে গাঁজা ভরে খায়, তারা স্নাতক স্তরে পৌঁছায়নি। সাধুদের আখড়ায় সিগারেটে গাঁজা খেলে গেরুয়াধারীরা বেশ অসন্তুষ্ট হন। “ইয়ে বাবাকা পরসাদ, ঠিকসে পিয়ো,” এক সাধু আমাকে ধমকেছিলেন।
গেরুয়াধারীর বকুনিতে মনে মনে আঘাত পেয়েছিলাম। কলকাতার ছেলে, কল্কে ধরতে পারব না? ছিঃ! আমার শহর গাঁজার ঐতিহ্যে ভরপুর। সাহেবি আমলের শুরুতেও মুখ্যত ভবঘুরে, বৈরাগী এবং নিম্নবর্গের কৃষিজীবীরাই গাঁজার নেশা করতেন। পরে কলকাতা শহর তৈরি হল, হাফ-আখড়াই, জেলেপাড়ার সঙ ও পক্ষীর দল শুরু হল। পক্ষী হওয়া মোটেই সহজ ছিল না। যে গেঁজেল টানা ১০৮ ছিলিম গাঁজা খেতে পারতেন, তাঁকে একটা ইট দেওয়া হত। এ ভাবে পাওয়া ইট দিয়ে যিনি ঘর তুলতে পারতেন, তাঁরই ‘পক্ষী’ খেতাব জুটত। দিল্লি, মুম্বই, নিউ ইয়র্ক গাঁজাকে ‘গ্রাস’ বলে আদিখ্যেতা শুরু করার ঢের আগে কলকাতাই শহুরে সংস্কৃতিতে প্রথম গাঁজাপ্রেম শুরু করে। সিপাহি বিদ্রোহের মাত্র দুই বছর পর ‘হুক্কাপুরাণ’ বইয়ে লেখা,
তামাকু হইল দেখ পৃথিবীর সার
গাঁজা ভাঙ ধুতুরা তবে হৈল অবতার।

লোকে আজকাল পশ্চিমবাংলা শিল্পায়নে, নগরায়ণে পিছিয়ে পড়ছে বলে ফালতু রব তুলছে। মনে রাখতে হবে, গঞ্জিকায়নে বাংলাই পথিকৃৎ!
গাঁজা টানলে বেশি কথা বলতে ভাল লাগে না, নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মনঃসংযোগ তখন একমুখী। মদের নেশাটা অন্য রকম। দু’তিন চুমুক দেওয়ার পর মনটা ছড়িয়ে যায়, কথা বলতে ইচ্ছা হয়। এ ব্যাপারে জঙ্গলমহল আর পাহাড়ের মদে তফাত নেই। বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে মহুয়ার মদ আর শুয়োরের মাংস নিয়ে চমৎকার আড্ডা জমে! মহুয়া গ্লাসে বা খুরিতে পান করা যায়, কিন্তু হাঁড়িয়া অন্য রকম। কানা উঁচু কলাইয়ের থালায় চুমুক দিতে হয়। দার্জিলিঙের পাহাড়ে আবার রক্সি। এক পেগ মারার পর শীত উধাও! কালিম্পং-এ ছাং। বাঁশের পানপাত্রে গরম জলে ভেজানো দানাশস্য। এ বার বাঁশের স্ট্র দিয়ে চুমুক। হাঁড়িয়ার মতো প্রথম স্বাদে টকটক, তার পর চমৎকার! মদের নেশায় পাহাড় আর জঙ্গলমহল একই ভাবে হাসে!
নেশা-টেশার জন্য আমি বিন্দুমাত্র লজ্জিত নই। জীবনেও চুরি, ছিনতাই করিনি। শুধু আনন্দের জন্য নেশা করেছি। হিন্দুর ছেলে, ঐতিহ্য যাবে কোথায়? ঋগ্বেদে সোমরসের কম প্রশংসা! ষষ্ঠ মণ্ডলের ৪৭ নম্বর সূক্ত: ‘এই সোম পীত হইয়া আমার বাক্যের স্ফুর্তি বিধান করিতেছে।’ পরে মহাকাব্যের যুগেও মাধ্বী, মৈরেয়, অরিষ্ট, আসব কত মদ! মেয়েরাও বঞ্চিত ছিলেন না। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে অভিমন্যুর শবদেহ আঁকড়ে পড়ে আছেন স্ত্রী উত্তরা।
সখেদে গান্ধারী বললেন, “মাধ্বীকের মত্ততায় মূর্চ্ছিত হয়েও যে উত্তরা স্বামীকে আলিঙ্গন করতে লজ্জা পেত, হায়, সে আজ সকলের সামনে পতির অঙ্গ পরিমার্জনা করছে।” মেয়েরা মদ খেলে তাদের ‘সচ্চরিত্র’ বলে কি না গোছের প্রশ্ন মন্ত্রী-সান্ত্রিদের মাথায় আসত না। অবশ্য মন্ত্রীদের আর দোষ কী! সিনেমার প্রচারে নেশা নিয়ে বলতে গেলে আজকাল ছেলেমেয়েরা ও সব চলবে না, নেশা করা অনুচিত ইত্যাদি ফতোয়া দেয়। অন্যের কথা শুনতে চায় না, ভাবে তাদের মতামতই সব! সাধে নেশাড়ুরা বলে, আ নেশন গেটস দ্য লিডার ইট ডিজার্ভস! প্রাণে বড় আনন্দ হল সে দিন, যখন শুনলাম, খাস ওবামাল্যান্ডে দু’দুটো রাজ্যে ‘আনন্দের জন্যে মারিজুয়ানা’ সেবনের আইন তৈরি হচ্ছে। আবার, তার ক’দিন পরেই খবর, উরুগুয়েতে সীমিত পরিমাণে মারিজুয়ানা কেনা যাবে, এমনকী চাষ করাও যাবে। আমেরিকা, উত্তর দক্ষিণ মিলে আমাদের সনাতন ঐতিহ্য ধরে ফেলল, ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়!
সত্যি বলতে কী, মারিজুয়ানাই বলুন আর যা-ই বলুন, আমাদের গঞ্জিকা হলেন সাক্ষাৎ অমৃতের সন্তান! অমৃত নিয়ে সুর আর অসুরে কাড়াকাড়ি। অবশেষে দেবতাদের কাছে অমৃত এল। শিব নিজের অঙ্গনিঃসৃত এক লতায় শোধন করে নিলেন অমৃত। অথর্ববেদ বলেছে, সেই পুণ্য উদ্ভিদই গাঁজাগাছ। মদ এবং গাঁজা দুই পক্ষকেই আমরা কুর্নিশ জানিয়েছি। উনিশ শতকে সাহেবরাই প্রথম ‘আমরা-ওরা’ তৈরি করল। বলা হল, বেশি গাঁজা খেলে লোকে পাগল হয়ে যায়, কিন্তু মদ উন্নততর নেশা।
গুলিখোর বাঙালি অবশ্য সাহেবদের ‘থিয়োরি’ বিনা বাক্যে মেনে নেয়নি। আফিমের গুলিই তখন সবচেয়ে এলিট নেশা। পুরনো ছড়া,
দেবের দুর্লভ দুগ্ধ ছানা
না হলে গুলি রোচে না
কচু ঘেঁচুর কম্ম নয় রে যাদু
শুঁড়ির দোকানে গিয়ে
ট্যাক ট্যাক ফেলে দিয়ে
ঢুক করে মেরে দিলে শুধু।

আমাদের কি শুধু মদ, গাঁজার নেশা! ক্ষমতার নেশা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সে কথা তুললে আমেজটা কেটে যাবে। তার চেয়ে বরং প্রেমের নেশার কথা হোক। অনেকটা হেরোইনের মতো। শুরুতে এসএমএস, মিষ্টি কথা, বন্ধুদের এড়িয়ে আলাদা ভাবে দেখা করা, রেস্তোরাঁ, সিনেমাহল, অনেক সময় ও শ্রমসাপেক্ষ। হেরোইন খাওয়ার প্রথম ধাপও সে রকম। সিগারেটের প্যাকেটের রাংতার ওপর সুগার রেখে তলায় আগুনটা এমন সন্তর্পণে ধরতে হয় যাতে রাংতা পুড়ে না যায়। কিন্তু গরম হয়ে যাবে, সুগার থেকে বাদামি ধোঁয়া উঠবে, বাঁকানো পাইপ দিয়ে টানতে হবে। তার পর শরীর শুকিয়ে যায়, তারাভরা রঙিন আকাশটা ভারী পাথরের মতো বুকে আছড়ে পড়তে চায়। কোনও অচেনা মেয়ের প্রেমে পড়লে ওই ভাবেই লাল-সবুজ আকাশ দেখতে হয়, বুকে পাথর চেপে বসে।
আর সাহিত্যের নেশা? যেন বাংলা মদ। সোডা বা ডাবের জল মিশিয়ে মেরে দাও। তার পর, ওই তো! কমলকুমার থেকে সুনীল, শক্তি, সকলে খালাসিটোলার টেবিলে বসে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বারদুয়ারিতে ঢুকছেন, ঋত্বিক ঘটক গড়চা থেকে বেরোচ্ছেন। মেট্রো সিনেমার পিছনে ছোটা ব্রিস্টলে এখনও ওয়েটাররা দু’হাতে দশটা গ্লাস নিয়ে ঢোকে। কোনওটায় রাম, কোনওটায় হুইস্কি। কোন টেবিলে কোনটা, এতটুকু ভুল হয় না। লালবাজারের পাশে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পধন্য সিসিল বার আজ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। অলি পাবে স্টিলের বালতি আর হাতায় বরফ আসে, সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েটার বোতল থেকে পেগ ঢেলে দেয়। কেন যে শহরের সাহিত্য সম্মেলনগুলি বারদুয়ারি, অলিতে হয় না! সে দিন কলাবাগানের ঠেক থেকে বাড়ি ফিরতে চমৎকার লাগল। কার্নিসে কার্নিস, ফুটপাথ বদল হয় ত্রিফলার নীচে। রেলিং-এ, রাস্তার ডিভাইডারে নীল-সাদা রং। দু’কান গরম। দু’চোখে দিব্যদৃষ্টি। বুঝে গেলাম, কেন মহারাজা রণজিৎ সিংহ বলেছিলেন, সব নীল হো জায়গা। :)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.