ব্রিটেনের একটি সমীক্ষায় জানা গেল, পুরুষগণ তাঁহাদের স্ত্রীগণকে ত্রুটিহীন বলিয়া কখনওই মনে করেন না। যে দুই সহস্র পুরুষ সমীক্ষার অন্তর্গত ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহই নিজ স্ত্রীকে ‘নিখুঁত’ ভাবেন না, বরং বহু ত্রুটিসম্পন্ন মনে করেন এবং প্রশ্ন করিলেই তৎক্ষণাৎ দোষগুলির তালিকা করিতে বসিয়া যান। কেহ মনে করেন তাঁহার স্ত্রী যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নহেন, কেহ ভাবেন মহিলা অতি মুখরা, কেহ স্ত্রীর ক্রীড়া-সম্পর্কিত অনাসক্তি দেখিয়া চিড়বিড় করিয়া জ্বলিয়া যান। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা হইল, ‘খুঁতো’ স্ত্রী পাইয়া ললাটে করাঘাত তো দূরস্থান, পুরুষগণ প্রায় সকলেই বিশ্বাস করেন, ‘নিখুঁত’ নারী বলিয়া কিছু হয় না, এবং যদি হয়ও, তথাপি তাঁহারা খুঁতসম্পন্না নারীদেরই অধিক পছন্দ করিবেন। ইঁহারা প্রায় সকলে ঝগড়ুটি ও সাজুনি অর্ধাঙ্গিনীকে লইয়া দিব্য সুখী। কেহ যদি সেই অর্ধাঙ্গিনীদেরই নিখুঁত করিয়া দেয়? মাত্র এক-পঞ্চমাংশ পুরুষ সেই প্রস্তাবে হ্যাঁ বলিবেন, বাকিরা খুঁতসমৃদ্ধাকে জড়াইয়া বসিয়া থাকিবেন, ছাড়িবেন না। পত্নীপ্রেম নহে, ইহা হইতে মনুষ্যহৃদয়ের অন্য ধাত বাহির হইয়া আসে: সে কাম্য বস্তুর মধ্যে ত্রুটি দেখিতে পছন্দ করে।
আপাত ভাবে উদ্ভট মনে হইলেও, একটু ভাবিলেই বুঝা যায়, আমরা সকলেই ‘নিখুঁত’কে ভয় পাইয়া থাকি, কারণ ভিনগ্রহীর ন্যায়, বস্তুটি প্রবল অচেনা, উহার সহিত পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য স্থানে আমাদের মোলাকাত হয় নাই। বহু মহাপুরুষ সম্পর্কে আমরা সর্বগুণসম্পন্ন কথাটি শুনিয়াছি, তাঁহাদের আখ্যান পড়িয়া শ্রদ্ধায় অবনত হইয়াছি, অনুজদিগকে শিক্ষা দিয়াছি উঁহাদের মতো হইয়া উঠিতে, কিন্তু তাঁহাদের দেবতার মতো দেখিয়াছি, যাঁহারা স্বর্গে সুন্দর, পাড়ার আড্ডাস্থলটিতে নহে। যতই দিবসে পঞ্চাশ বার গুচ্ছ প্রার্থনা লাগাইয়া রাখি না কেন, সহসা জ্যোতির্ময় অস্তিত্ব লইয়া দেবতা যদি সত্যই তেলচিটা তক্তপোশটির পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ান, ছ’ফুটিয়া মহত্ত্বের সম্মুখে তিলার্ধ টিকিতে না পারিয়া তড়িৎগতিতে চম্পট দিব। অমন অপরিচিতকে সহ্য করিতে পারিব না। এক মহাপুরুষ বলিয়াছিলেন, মৈত্রেয়ীকে লইয়া বনে যাওয়া চলে কিন্তু কাত্যায়নীকে ছাড়া সংসার চলে না। সত্যই, আমরা ক্ষুদ্র সংসারী মনুষ্য, অমৃত টলটল করিলে জাদুঘরে দেখিতে যাইব, অমৃত-অবসেশন ঘরে আনিব কেন? এই ত্রুটিময় পৃথিবীর ধূলিতে নিখুঁত মানুষ আমাদিগের আদর্শ, কিন্তু আলগা জড়াইয়া চলিবার, হাসি-কান্না বাঁটিয়া লইবার অবলম্বন কখনওই নহে। নিমন্ত্রণগৃহে গিয়া রবীন্দ্রনাথকে ফিশফ্রাই খাইতে দেখিলে আপনি কি তাঁহার সহিত রসালাপে প্রবৃত্ত হইবেন, না পাঁইপাঁই পলাইয়া দ্রুত আত্মীয়দিগের বলয়ে আসিয়া দাঁড়াইবেন ও নিরন্তর উঁকিঝুঁকি মারিবেন? আসলে, নিখুঁত আমাদিগকে স্বস্তি প্রদান করে না।
নিখুঁতকে আমরা মনে করি অসম্ভব কিছু। তাহা অতিমানবিক এবং সুতরাং অ-মানবিকও বটে। অন্তত আমার পক্ষে ওই তুঙ্গ স্পর্শ করা অসাধ্য। তাহা জানিয়া, কী করিয়া তাহার সহিত মিশিব? বাধ্যতামূলক হীনমন্যতায় তো হস্তপদহৃদয় আড়ষ্ট হইয়া যাইবে! তাহার সহিত সহজ কথা কী করিয়া বলিব? ক্রমাগত মনে হইবে, আমার আঁচিলময় পাতিত্ব পড়িয়া ফেলিয়া সে আমায় তীব্র অবজ্ঞা করিতেছে। আমি যে কখনওই কোনও কিছুতেই তাহার সমকক্ষ হইয়া উঠিতে পারিব না, এই বোধ আমাকে তাহার সম্পর্কে প্রবল সমীহ ও সমধিক ঘৃণায় নিমজ্জিত করিবে, কিছুতেই প্রেমের জন্ম দিবে না। যদি জানি যে আমার স্ত্রী এক বেদিতে অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাঁহার সহিত কলহে প্রবৃত্ত হইব কোন সাহসে? তাঁহাকে স্থূল অশালীন আনন্দে আমন্ত্রণ জানাইব কী উপায়ে? কেবল হৃদিমধ্যে গণিত কষিতে হইবে, কী করিয়া ওই নিখুঁতের মনোমতো হইয়া উঠিতে পারি। জীবন বিভীষিকাময় পরীক্ষা হইয়া উঠিবে। তাই নৈখুঁত্য বিলক্ষণ প্রীতিঘাতী। আমাদিগের বক্তব্য: নিখুঁতকে দূরে পরিহার, দূর হ’তে করি অ্যাডমায়ার! |