চাষের খেত থেকে পোলট্রির ফার্ম। ফড়ে-রাজের কবলে হাঁসফাঁস করছে রাজ্যের মুরগি ব্যবসাও। আর, সেই ফাঁস কেটে বেরোতে এ বার উদ্যোগী হচ্ছেন উৎপাদকেরাই। রাজ্যের মানুষকে কেজি প্রতি একশো টাকায় মুরগি ও সাড়ে তিন টাকা দরে ডিম খাওয়াতে চাইছেন ওঁরা।
কী ভাবে? এখানেও মডেল কৃষি বিপণনের আধুনিক ব্যবস্থাই।
কারণ, চাষিই হোন বা মুরগির কারবারি, ফড়েদের দাপট একই রকম ভাবে ভুগতে হয় তাঁদের। সব্জি বাজারে লাভের গুড় খেয়ে যান ফড়ে ও খুচরো ব্যবসায়ীরা। দাম পান না চাষিরা। একই অবস্থা এখন রাজ্যের মুরগি ও ডিম উৎপাদকদেরও। তাঁদের কাছ থেকে ব্রয়লার মুরগি কেজি প্রতি ৫৫ টাকা দরে কিনে, বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ১৫০ টাকায়। একই ভাবে ডিম-পিছু উৎপাদক লাভ করছেন মাত্র দশ পয়সার মতো। সেখানে ফড়েদের ডিম-পিছু লাভ থাকছে এক টাকারও বেশি। উৎপাদক এবং সাধারণ খরিদ্দার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দু’পক্ষই।
রাজ্যের পোলট্রি ফেডারেশনের কর্তা মদনমোহন মাইতি বলছেন, “গত এক বছরে উৎপাদনের খরচ মারাত্মক বেড়েছে। কিন্তু ফড়েরা কেজি প্রতি ৫০-৫৫ টাকার বেশি দাম দিচ্ছেন না। অথচ সেই মুরগিই বাজারে ১৫০ টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে।” মদনবাবুর দাবি, মুরগি বিক্রি করে এখন কেজি পিছু ১৫-২০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে রাজ্যের প্রায় ২০ হাজার মুরগি উৎপাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন বলেও দাবি মদনবাবুর।
প্রতিকারের উপায়? উত্তর ২৪ পরগনায় জয়পুর গ্রামে সরাসরি বড় বিনিয়োগকারীদের কাছে সব্জি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। সেখানে চাষিদের কাছ থেকে সব্জি কিনছে ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’। এলাকার চাষিদের বক্তব্য, তাতেই পাল্টে গিয়েছে গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। অথচ আশপাশের গ্রামের চাষিরা জানিয়েছেন, ফড়েরা এতটাই কম দাম দিচ্ছেন যে, সব্জি ফলিয়ে চাষের খরচই তুলতে পারছেন না তাঁরা।
মুরগি ও ডিমের বাজারে ‘মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’-র মতো বড় বিনিয়োগ কার্যত নেই বললেই চলে। কিন্তু পড়ে পড়ে মার খাওয়ার চেয়ে ফড়েদের সঙ্গে যুঝতে নিজেরাই নয়া বিপণনের রাস্তায় হাঁটতে চলেছেন মুরগি ও ডিম উৎপাদকেরা।
কী সেই রাস্তা?
আপাতত পোলট্রি খামার থেকে মুরগি ও ডিম সরাসরি বাজারে এনে বিক্রি করতে চাইছে পোলট্রি ফেডারেশন। ফেডারেশনের কর্তারা বলছেন, কলকাতা ও সল্টলেকে ন্যায্য দামের ১৫০-২০০টি বিপণি খুলতে চান তাঁরা। আর জেলা শহরগুলিতে ১০টি করে আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সব বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কম দামে মুরগি ও ডিম বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। মুরগি উৎপাদকদের আশা, কম দামে ব্রয়লার ও ডিম বিক্রির কিছু ‘আউটলেট’ খুলতে পারলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতার বাজারে দাম কমাতে বাধ্য হবেন অন্য বিক্রেতারাও। এতে বিক্রি বাড়বে। বহু গরিব মানুষও সস্তায় প্রোটিন পাবেন। উৎপাদকদেরও বেশি লাভ হবে।
কলকাতা পুরসভার কাছে মদনবাবুরা ইতিমধ্যেই এ জন্য জায়গা চেয়েছেন। শিলিগুড়ি, বর্ধমানের মতো শহরগুলিতেও পুরসভার কাছে আর্জি জানাবেন তাঁরা। চাষিদের ক্ষতির কথা বলে এ রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার।
কিন্তু খুচরো বাজারে মুরগির দাম নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টাই সরকারের তরফে দেখা যাচ্ছে না বলে আক্ষেপ বহু পোলট্রি কারবারির। এই পরিস্থিতিতে পুরকর্তারা কি সাহায্য করবেন মুরগি উৎপাদকদের? এখনও পর্যন্ত অবশ্য কলকাতার পুর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সদর্থক কোনও জবাব পাননি মুরগির কারবারিরা। মেয়র পারিষদ (বাজার) দেবাশিস কুমার অবশ্য বলছেন, “কলকাতার কয়েকটি বাজারে এই ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গরিব মানুষ সস্তায় মুরগি খেতে পারলে আমাদের আপত্তি নেই।”
কিন্তু পুরসভার কাছ থেকে জমি নিয়ে নতুন আউটলেট খুলতেও তো বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তার মধ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুললে, দেশি-বিদেশি আউটলেট-এর সুবিধা আরও বাড়লে কি উৎপাদকরা উপকৃত হতেন না?
মুরগি ব্যবসায়ীরা অনেকেই বলছেন, সুবিধা তো হতই। “আমাদের লক্ষ্য সরাসরি খরিদ্দারের কাছে পৌঁছনো। যাতে আমরাও সঠিক দাম পাই, খরিদ্দারও ন্যায্য দাম দেন!” বড় বিপণি এলে সেই লক্ষ্য পূরণে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে আর ফড়েদের দাপটও দূর হবে, নিশ্চিত ওঁরা। |