পুস্তক পরিচয় ২...
শুধু দেখলেই হয় না, পড়তেও হয়
ফিল্মিং ফিকশন/ টেগোর, প্রেমচন্দ, অ্যান্ড রে,
সম্পা: এম আসাদুদ্দিন ও অনুরাধা ঘোষ। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৬৯৫.০০
য়িতা সেনগুপ্তের মনে হয়েছে, সত্যজিৎ যখনই রবীন্দ্রকাহিনি নিয়ে ছবি করেছেন, কবির অন্তর্দৃষ্টি বা মননকে যথাযথ বুঝেই চিত্রায়িত করেছেন। কিন্তু কবির প্রতি তাঁর সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য সম্ভবত ‘ঘরে বাইরে’, যে ছবিতে তিনি কবির ভাবনাকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্তরে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন।
এই অবধি শুনে কেউ তর্ক করার জন্যে ফুঁসে উঠতেই পারেন, তবে জয়িতার দীর্ঘ রচনাটি পড়ার পর স্তিমিত হতেই হবে তাঁকে। ফিল্মিং ফিকশন/ টেগোর, প্রেমচন্দ, অ্যান্ড রে বইটিতে জয়িতা তাঁর আলোচনাটি আদ্যোপান্ত এগিয়েছেন ‘ঘরে বাইরে’ ছবির সাংগীতিক কাঠামোয় ভর করে। সেই চলচ্চিত্রীয় ভাষার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে উপন্যাসটি পুনরাবিষ্কারের শেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসছেন: দ্য ফিল্ম অ্যাজ আ রি-ক্রিয়েশন অ্যাবাউন্ডস উইথ ফাইন টাচেস অব ‘অর্কেস্ট্রাল প্লেনিচুড’ টু একজেমপ্লিফাই অ্যান্ড এক্সপ্যান্ড দ্য হিস্টোরিক্যাল ডাইমেনশন অব দ্য পিরিয়ড।
সত্যজিৎ নিজেও ইউরোপীয় ধ্রুপদী সংগীতের বিস্তারের ঢঙটার সঙ্গে সিনেমার গল্প বলার ঢঙটার খানিকটা মিল কোথায় তা জানিয়েছেন: ‘ইউরোপিয়ান সংগীতের নাইনটিনথ সেঞ্চুরিতে, মোৎসার্ট, হাইডেন, বেঠোভেনের সময় সোনাটা ফর্ম বলে একটা জিনিস, আবিষ্কৃত হয়েছিল, তাতে একটা নাটকীয়তা আছে,... তার মধ্যে সত্যি করেই একটা থিম, তারপর একটা কাউন্টার থিম, দুটোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সে দ্বন্দ্ব ঘিরেই আবার সংগীতের কিছু অংশের ঘুরপাক, তারপর সেই দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি, তা এটাকে ড্রামাটিক ফর্ম বলা যেতে পারে।’
আসলে সত্যজিতের বরাবরই খেদ, ‘আমাদের সমালোচকেরাও ছবি বিচার করে এসেছেন মুখ্যত ছবির বক্তব্য ধরে, কীভাবে সেই বক্তব্য প্রকাশ পেল, তা ধরে নয়।’ তাঁর মতে, ছবি যা বলে তাতে চলচ্চিত্রকারের ব্যক্তিত্বের অংশমাত্র ধরা পড়ে, কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা ধরা পড়ে ছবিটা কী ভাবে বলা হল, তারই মধ্যে দিয়ে।একে নিছক সত্যজিতীয় ভাবনা মনে করলে ভুলই ভাবা হবে, চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার কিন্তু এটাই দস্তুর, আর তা পাওয়াও গেল জয়িতার কলমে। এমন দস্তুর মেনেই সুসম্পাদনায় বইটি সাজিয়েছেন এম আসাদুদ্দিন আর অনুরাধা ঘোষ। ‘ফিল্মিং ফিকশন/ সাম রিফ্লেকশনস অ্যান্ড আ ব্রিফ হিস্টরি’— এই ভূমিকা-প্রবন্ধটিতে তাঁরা স্পষ্টতই জানাচ্ছেন যে, কোনও উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা আর তা নিয়ে তৈরি ছবি দেখার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক নিয়মে আলাদা হওয়া বাঞ্ছনীয়। তফাতটা বাধ্যত মাথার মধ্যে ঢুকে থাকাটাই কাঙ্ক্ষিত, এবং ‘ইট ইজ দিস প্রসেস দ্যাট ডিফাইজ ইজি ট্রানস্লেশন ইনটু ফিল্ম।’
ভূমিকা ছাড়াও অনুরাধা বইটিতে আর একটি স্বতন্ত্র লেখায় জানাচ্ছেন, যে মুহূর্তে কোনও কাহিনি থেকে ছবি হচ্ছে সে মুহূর্তেই কাহিনির শব্দাশ্রিত ‘ন্যারেটিভ’কে ‘রি-কোড’ করা হচ্ছে ‘মুভিং ইমেজ’-এ, ফলে ‘দ্য প্রসেস অব অর্ডারিং দ্য টেলিং অব আ স্টোরি ইনভলভস আ কমপ্লেক্স স্ট্রাকচারাল অর্গানাইজেশন।’ অথচ এর বিপরীতে বাংলা ছবি বরাবরই সাহিত্যাশ্রয়ী এবং জনপ্রিয় হয়ে থাকতে চেয়েছে, কাহিনির সারটুকু সহজ ‘ট্রানস্লেশন’-এ আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। এমন তো নয় যে সাহিত্যের বহুমাত্রিক জটিলতা বা সূক্ষ্মতা চলচ্চিত্রে অনায়ত্ত, বরং দুটি শিল্পমাধ্যমই তাদের স্বাতন্ত্র্যের ব্যবধান অতিক্রম করেছে অনেকটা, নির্ধারিত সীমা ভেঙে নিজেদের নিকটবর্তী করেছে পরস্পরের কাছে। ফলত মিথস্ক্রিয়া বা সমবায়েরও সৃষ্টি হয়েছে।
যে ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল সে ছবিকেই উদাহরণ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। ছবিটি যখন মুক্তি পায়, প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল, তখন উপন্যাসটি ভাল না ফিল্মটি ভাল, এর যুক্তিসংগত সংযোগ নিয়ে বিতর্ক চলেছে বিস্তর। কিন্তু একজন সেরা ঔপন্যাসিকের সঙ্গে একজন সেরা চলচ্চিত্রকারের নান্দনিক মিথস্ক্রিয়ায় কী কী সমস্যা হতে পারে শিল্প নির্মাণে, তেমন আলোচনা হয়েছিল খুবই কম। এ-বইয়ে সুপ্রিয়া চৌধুরীর রচনা, বা সোমদত্তা মণ্ডলের লেখা সে দিনের সে অভাব পূরণ করবে অনেকটাই।
লিখেছেন আরও অনেক গুণিজন, লিখেছেন শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, প্রেমচন্দের সাহিত্যের সঙ্গে সত্যজিতের সিনেমার সমবায় বা সম্পর্ক নিয়েও। ‘তিনকন্যা’, ‘চারুলতা’র সঙ্গে তাই বইটিতে দীর্ঘায়ত আলোচনা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’, ‘সদ্গতি’ নিয়েও। পড়তে-পড়তে কারও মনে হতেই পারে আলোচনাগুলি অ্যাকাডেমিক, কিন্তু সেটাই কাম্য। কারণ, ১৯৫৫-য় দীর্ঘদেহী যে মানুষটি তাঁর ফিল্মের শিল্পকাঠামোকে আমাদের কাছে অনিবারণীয় করে তুলেছিলেন, তাঁর ছবি থেকেই আমরা শিখেছি যে, ছবি শুধু ‘দেখলে’ই হয় না, তা ‘টেক্সট’ হিসাবে বারে বারে ‘পড়তে’ও হয়!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.