|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
আজীবন সঙ্গীহীন এক দ্রষ্টা |
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় |
আন্তোনিয়োনি/ সেন্টিনারি এসেজ, সম্পা: লরা রাসকারোলি ও জন ডেভিড রোডস।
ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও পলগ্রেভ ম্যাকমিলান, মূল্য অনুল্লেখিত |
চিত্রনাট্যের আদর্শ হিসেবে সত্যজিৎ রায় ‘লাভেঞ্চুরা’র সূচনাকে দৃষ্টান্ত ভাবতেন; সততার প্রশ্নে ঋত্বিক তাঁকে ‘পরমাত্মীয়’ ভাবেন; মৃণাল সেন আজও আচ্ছন্ন রয়েছেন তাঁর ‘লা নত্তে’ রচনায়— ইতালীয় চলচ্চিত্রস্রষ্টা মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিয়োনি-কে (১৯১২-২০০৭) নতুন ভাবে চেনানোর তেমন পরিসর আর কোথায়? শিল্পের ইতিহাসে তিনি তো এমন শকুন্তলার আংটি, যা দেখলেই আমরা শনাক্ত করতে পারি মৃত-নিরবয়বী সময়; দার্শনিক অনিশ্চয়তা; অস্তিত্ববাদের গহন প্রশ্নমালা। আধুনিকতার প্রথম পথিক বোদলেয়ার যে অনুভূতিহীনতাকে ‘অনুই’ নামে বিখ্যাত করেছেন চিত্রভাষার সেই ঐতিহ্যের মূলেই এক সময় চলচ্চিত্রবেত্তারা ‘আন্তোনিয়েনুই’ শব্দটি আবিষ্কার করেন।
|
|
মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিয়োনি (১৯১২-২০০৭) |
আমরা কি জানতাম সমুদ্রে শূন্যতা আছে— তাতে পরাগ সঞ্চার করা যায়? লাভেঞ্চুরা আমাদের মর্মে শিলমোহর দিয়ে দিল। শূন্যতাকে কেন তাঁর মনে হয় নক্ষত্র নারীর কেশপাশ? মনিকা ভিত্তির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার সময় আমরা বুঝতে পারিনি আন্তোনিয়োনি কী অসম সাহসেই না বাস্তবতার কুচকাওয়াজ পরিহার করে চুম্বন করেন বাস্তবের আপাত অদৃশ্য অবতলে। সেখানে সিন্ধু রূপসীর কটিদেশ গোঙায়, শহর সেখানে লাল মরুভূমি, সেই অলীক প্রদেশে আন্তোনিয়োনির চিত্রপুঞ্জ— লাভেঞ্চুরা (১৯৬০), লা নত্তে (১৯৬১), লে ক্লিসে (১৯৬২), রেড ডেজার্ট (১৯৬৪) বা ব্লো-আপ (১৯৬৬) আমাদের স্মৃতিতে ঝরে পড়ে কবরখানার রতিমুদ্রা হিসেবে; আন্তোনিয়োনি তাকিয়ে থাকেন আর বাস্তব স্তর থেকে স্তরান্তরে মানে পালটে নেয়। আন্তোনিয়োনি বলতেই আমরা বুঝতাম যুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদের মর্মান্তিক শিলমোহর: বিচ্ছিন্নতা ও নিথর সময়, প্রয়োগের দিক থেকে দেখলে মন্থর প্যানিং; ওয়াইড স্ক্রিনানুগ লং টেক; সম্পাদনার সময় ফ্রেমের বাড়তি আঁচল রেখে যাওয়া। এক দল সমালোচক তো বলতেই শুরু করেছিলেন আন্তোনিয়োনি একটি যুগচিহ্ন। অস্তিত্ববাদের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে লিখন তাহার ধূলায় হয়েছে ধূলি। হেসে বলার যে, শিল্পীরা অত ক্ষীণজীবী নন। আজ যখন ওয়াল স্ট্রিট টালমাটাল তখন লে ক্লিসের শেয়ার বাজার আমাদের কাছে ইতিহাসের জ্যান্ত রূপকথা। এশিয়ার নতুন ছবিতে, বিশেষত তাইওয়ানের নবতরঙ্গে এডওয়ার্ড ইয়াং ও সাই মিঙ লিয়াং প্রমুখ রচয়িতার মধ্যে তিনি পুনরুত্থিত দেবদূত। সম্পদের দারিদ্র, বাস্তবিক নগরায়ণের নব নব চিহ্নায়ন আন্তোনিয়োনিকে অপ্রত্যাশিত ভাবে সমকালীন করে তুলছে প্রতিনিয়ত, আর সেই পুনরাবিষ্কারের সন্ধান পেলাম এই শতবর্ষে নিবেদিত সন্দর্ভসমূহে। সম্পাদক দু’জন, লরা রাসকারোলি ও জন রোডস, দৃশ্য সংস্কৃতির প্রতিনিধি; ফলে এমন কয়েকটি লেখা পড়ার সুযোগ এল, যা আন্তোনিয়োনিকে শুধুই রুগ্ণ সময়ের চিত্রকর হিসেবে বর্ণনা করেনি বরং মেধার নতুনতর স্তরে তাদের অভিযান।
সেই সব ‘আকস্মিক, ক্ষণপ্রভ, অন্তর্বর্তী’ দৃষ্টিপাত, যা বোদলেয়ারের সৌজন্যে আধুনিকতার বর্ণমালা, তা আন্তোনিয়োনির চিত্রসাম্রাজ্যে কী ভাবে ডালপালা ছড়ায়, তা নিয়ে এই বইয়ের প্রথম পর্যায়: আধুনিকতাসমূহ। জাকোপো বেনচি অসামান্য উৎসাহে রোম শহরের পথে আন্তোনিয়োনির গমনরেখা অনুসরণ করায় শহর ও আধুনিকতা বিষয়ে কিছু দামি তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে। আধুনিক ফ্ল্যান্যেরি বিষয়ে ভাবনাচিন্তার জন্য এই প্রবন্ধটি কিছু মৌলিক সুগন্ধ ছড়ায়। জীবনানন্দ থাকলে নিশ্চিত বলতেন: ‘হৃদয় অনেক বড়ো বড়ো শহর দেখেছো তুমি!’ জাব্রিস্কি পয়েন্ট (১৯৭০) ছবিটিকে একদা আদ্যন্ত ভুল বুঝেছিলেন ধ্রুপদী সমালোচকেরা। কিন্তু ৯/১১ পরবর্তী যুগে এই ছবি শুধু আন্তোনিয়োনির দূরগামী প্রজ্ঞার সাক্ষী হয়ে রইল না, দেলুজের সাহায্য নিয়ে এই ছবিতে দৃশ্যের বিচ্ছুরণ ও এফেক্ট বিষয়ে চমৎকার অভিনিবেশে নিযুক্ত থেকেছেন চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক আনজেলো রেস্তিভো। ‘ব্লো-আপ’ বিষয়ে লরা রাসকারোলি ও মাতিলদা নারদেল্লি দু’টি রচনা নিবেদন করেছেন। প্রথমটি আধুনিকতার প্রতিরূপায়ণ থেকে বিকল্প গঠন সংক্রান্ত অনুসন্ধান। অন্যটি আলোকচিত্র কী করে অর্থের বহুত্ব খোঁজে, সে বিষয়ে রল্যাঁ বার্তের অর্থের পরিপূরকতার সৌজন্যে একটি আধুনিক গবেষণাপত্র। প্রথম জন ছাড়া প্রত্যেক লেখকই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেই সংকলন গ্রন্থটি অ্যাকাডেমিক ভঙ্গিতেই তর্ক বিস্তার করেছে। হয়তো আন্তোনিয়োনিকে একুশ শতকের মনীষার কার্যকরী সহযোগী বর্ণনা করার উৎসাহে কোনও কোনও লেখায় পরিবেশ ও নন্দনতত্ত্বের অতিশয়োক্তি আছে, কিন্তু ষাট দশকের বাইরে এসে এই মহাপ্রতিভা তো আক্ষরিক অর্থেই বীজের বলাকা। পূর্ণতা ও শূন্যতা, কেন্দ্র ও পরিধির অন্তর্বর্তী এক পরিসরে আন্তোনিয়োনি সঙ্গীহীন দ্রষ্টা থেকে গেলেন আজীবন। আজ নৈশ সড়কে অথবা সাইবার স্পেসে মানুষের বিস্মিত হওয়া প্রায় নেই। কিন্তু যা অবাঙমানসগোচর, যা অজ্ঞেয়, যা নৈতিক, যা অপরিচয়ের, আন্তোনিয়োনি শূন্যতার সেই হাহাকার শুনতে চান। কথা, বাসনা ও অন্যান্য কারুকাজ বৃথা হয়ে গেলে আন্তোনিয়োনি দেখার তপস্যা শুরু করেন। তার চিত্রমালা, অতএব দেখার প্রতিবেদন, বইটি পড়ে আবার মনে হল ‘দেখা’— এই ক্রিয়াপদটিই আন্তোনিয়োনির জীবনীতে স্বরবর্ণ। আর, তার অনেকটাই হয়তো আমাদের বিস্ময়কর ভাবে অদেখা। |
|
|
|
|
|