শনিবারের নিবন্ধ
আপনিও হতে পারেন শতায়ু
হান্ড্রেড ব্যাটিং। এখনও টি-ব্রেক হয়নি।
অমরত্বের সন্ধান না-ই বা পেলেন। কিন্তু বহাল তবিয়তে চলে ফিরে ওই তিন জন পেরিয়ে গিয়েছেন শতবর্ষের দুর্ভেদ্য দরজা!
তার পরেও শরীর-মনে বিস্ময়কর ভাবে তরতাজা এই তিন শতায়ু।
ভাবতে পারেন, যে-সব রোগ মধ্যবয়সেই গড়পড়তা বাঙালিকে কাত করে দেয়, তিন শতায়ুর ব্যাধিহীন দুনিয়ায় সে-সবই কয়েকটি শব্দ মাত্র?
কী ভাবে, কোন মন্ত্রবলে, শতবর্ষেও তাঁদের কণ্ঠস্বর, চশমাহীন চোখ, শ্রবণশক্তি বা স্মরণশক্তি ও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো?
অলৌকিক? আষাঢ়ে গল্প বলে মনে হচ্ছে?
“রোগব্যাধি কী জানি না। সুস্থ ভাবে এখনও দিব্যি বেঁচে আছি। এখনও রাত জেগে টিভি-তে জেমস বন্ড বা হিচককের ছবি দেখি।”
এই তো সেদিন একশো বছরের জন্মদিনে সেলফোনে ক্রমাগত ‘হ্যাপি বার্থডে’ শুনতে শুনতে আর এসএমএসের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে জানালেন, বরাহনগরের নিপাট এক বাঙালি সুশান্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
লখিন্দরের লোহার বাসর-ঘরে ছিদ্র থাকলেও তাঁর লৌহময় জগৎ এখনও অভেদ্য। দমদমের যোগীপাড়ার পকেট হারকিউলিস মনোহর আইচ এখনও এই শতবর্ষেও সংবর্ধনা নিতে অবলীলায় উড়ে যান মুম্বই, বেঙ্গালুরু-তে। “আর এই মাসেই গিয়েছিলাম দিল্লি।”
“শতবর্ষের জন্মদিনে রাজার সাজে ঘোড়ার গাড়িতে করে বাবাকে ঘোরানো হয়েছিল গোটা পাড়া। সকাল থেকেই আমাদের বাড়ি যেন ভেঙে পড়ছিল মানুষের ভিড়ে”, জানালেন মনোহর-কন্যা বাণী।
আর প্রয়াত হওয়ার আগে এই সে-দিনও ১০৭ বছর বয়সেও অবলীলায় সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে পেয়ারা গাছ থেকে ফল পেড়ে এনেছেন কোলাঘাটের রতিকান্ত চক্রবর্তী।
কোলাঘাট থেকে ঘাটাল, মেচেদা থেকে তমলুক ১৯০২ সালে জন্মানো রতিকান্তবাবু সারা জীবন হেঁটেই যাতায়াত করেছিলেন লাঠি ছাড়াই। “হয়ত এই হাঁটাহাঁটির জন্যই এত দিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকলাম’’, অনুমান করেছিলেন তিনি। আর খাওয়াদাওয়া করেছেন সময় মেপে। রাত ৮টায় শুতে চলে যেতেন তিনি।
যোগব্যায়াম-কপালভাতি-প্রাণায়াম-ভস্তিকা নয়, জিমযাত্রাই মনোহর আইচের নীরোগ জীবনের চাবিকাঠি, এমনটাই দাবি করেন তিনি।
তাঁর শোওয়ার ঘরের দরজার মাথায় ছবিটা দেখলে বিস্ময়াবিষ্ট না হয়ে উপায় নেই। শততম জন্মদিনে তোলা ছবি। মুঠো করা হাতের বাইসেপ এই বয়সেও যেন লোহা। সারা শরীরে তরঙ্গের মতো মাসল্স। মুখমণ্ডলে শতবর্ষের দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির বদলে শিশুসুলভ হাসি। তাঁর সাফ কথা, “জিমে যাওয়াটাকে জীবনের অঙ্গ করতে হবে তরুণদের। কারণ হজমের দাওয়াই তো শরীরচর্চাই। খাওয়া হজম হলেই শরীরের বাড়বাড়ম্ত। ডাক্তার বাড়ির বাইরে।” ঠিক যেন অঙ্কের হিসেবের মতো। “প্রতিদিন করলে শরীর হয়ে যাবে অজর।”
শতায়ু সুশান্তবাবু জন্মেছিলেন ১৯১২ সালের ২১ অগস্ট। কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির প্রাক্তন কর্মীর এখনও ঘুম ভাঙে ব্রাহ্ম মূহূর্তে। বাঁধাধরা খাদ্যাভ্যাসে তিনি অভ্যস্ত হলেও খাদ্যতালিকায় ডিম-মাছ থাকেই। রাতে কিন্তু তিনি নিরামিষাশী।
“সারা জীবন বাবার দৈনিক রুটিনে হেরফের নেই। সকালে চা থেকে রাতের খাবার সময়ের নড়াচড়া হয় না বললেই চলে”, জানালেন সুশান্তবাবুর পুত্রবধূ অপর্ণা।
“সারা জীবনই বাবা খাওয়াদাওয়া করেছেন সময়ের সঙ্গে তাল রেখে। এখনও করেন”, বাবাকে রাতের খাবার দিতে দিতে জানালেন বাণী। “সে-দিন পর্যন্ত সবই খেতেন। এখন চিঁড়ের পায়েস-মাছ-ভাত-দুধ-কলার মতো সহজপাচ্য খাবারই পছন্দ করেন।” তিন বছর আগে মনোহরবাবুই না বলেছিলেন, কম খেলে বেশি বাঁচবে, বেশি খেলে কম বাঁচবে?
সারা দিনে কী করেন দুই শতায়ু? “বঙ্কিম-শরৎ-রামায়ণ-মহাভারত থেকে খবরের কাগজ সবই পড়ি”, জানালেন সুশান্তবাবু। প্রয়াত হওয়ার আগে কোলাঘাটের রতিকান্তবাবুও তো তা-ই করতেন। টিভি-তে বিভিন্ন ধারাবাহিকও নিয়মিত দেখেন সুশান্তবাবু। “খবর শোনার পাশাপাশি চোখ রাখি চেলসি-ম্যাঞ্চেস্টারের ম্যাচেও।” “দাদু রাত জেগে অলিম্পিকও দেখেছেন,” জানালেন তাঁর দিল্লিপ্রবাসী নাতি সঞ্জয়। আর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ হলে? “একেবারেই দেখি না।” সুশান্তবাবুর প্রিয় গায়ক বেগম আখতার আর মান্না দে।
“৯৮ বছর বয়স পর্যন্ত দাদু একা-একাই ট্রেনে করে দিল্লিতে আমাদের বাড়িতে এসেছেন, ভাবা যায়?” বললেন সঞ্জয়।
আর মনোহরবাবু এখনও সকালে কাগজে চোখ রাখেন, ব্যায়ামের বই পড়েন। তবে টিভি-তে রুচি নেই তাঁর। “কেবল সময় নষ্ট”, বলেন তিনি। আর সারা দিন বিশ্রামেই কাটান।
দীপাবলির রাতে বাজি ফাটাবেন নাকি? ‘দীপাবলিতে বাবা মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক বাজাতেন। ঢাক বাজিয়ে হিসেবে ওঁর দক্ষতা ছিল দুর্দান্ত। বাজি ফাটাতে তেমন আগ্রহ তাঁর আমি দেখিনি”, জানালেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র খোকন ওরফে মনোজ। তবে এখনও পছন্দ করেন বাজিফাটানো দেখতে, জানালেন তিনি।
সুস্থ ভাবে যাঁরা বহু দিন বেঁচে থাকবেন, তাঁদের জন্য কী দাওয়াই দিলেন দুই শতায়ু?
“কোনও ব্যাপারেই কখনও টেনশন করবেন না। যা হবে, তা হবেই। কেউ রোধ করতে পারবে না। তা হলে ভেবে কী করবেন?” এই যুক্তিতেই একমাত্র ছেলের অকালমৃত্যুতেও ভেঙে পড়েননি সুশান্তবাবু। তবে মৃত্যুর আগে একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা আছে তাঁর। “দেখি কী হয়।”
আর মনোহরবাবু সাফ জানালেন, “উপদেশ এখন কেউ শোনে না। বলে কী লাভ?”
এ জীবনে কী পেলেন? “কেন, দেশকে আট-ন’জন ভারতশ্রী উপহার দিয়েছি। স্বাস্থ্যসাধনা করে সারা জীবন ফিট থেকেছি। একশো বছর পর্যন্ত হেসেখেলে বাঁচলাম। এই বা কম কী?”
কোনও দুঃখ? সরকারি সাহায্য বা নিয়মিত অনুদান কোনও দিনই পাননি। কিন্তু এ সবও তাঁর মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি। এই না হলে পকেট হারকিউলিস!
চলে আসার আগে করমদর্র্নের সময় ইচ্ছা করেই জোরে চাপ দিলেন। শতবর্ষেও মুঠোয় এত জোর! পরিষ্কার যেন সমঝে দিলেন, দীর্ঘজীবনের রহস্যের চাবিকাঠি শরীরচর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। আজকের প্রজন্ম কি শুনছে?

কী করে বেশি বাঁচবেন
• জেমস বন্ড কী হিচককের ফিল্ম দেখুন
• চেলসি-ম্যাঞ্চেসটার ম্যাচটাও ছাড়বেন না
• ফেভারিট গান শুনুন, বই পড়ুন
• উৎসবে ফুর্তি করুন
• পারলেই হিল্লি-দিল্লি, লাগান ছুট

ব্যাকরণ মেনে
সক্রিয় জীবনযাপন করুন।
কায়িক পরিশ্রম করুন। চিন বা জাপানে ডায়বেটিস বা হৃদরোগ তেমন নেই। ভারতে সবচেয়ে বেশি। কেন জানেন? কায়িক পরিশ্রমে আমাদের অনীহা। সাহেবেরা বাড়িতেও কাজ করে। গাড়ি বা দু’চাকায় সর্বদাই যাতায়াত করবেন না। প্রচুর হাঁটুন। এক তলা থেকে দো’তলায় ওঠার সময়ও দেখি অনেকেই লিফট ব্যবহার করেন। কেন?
‘নেচার’ আর ‘নার্চার’ এই নিয়েই আমাদের জীবন। প্রকৃতিগত শরীর নিয়েই তো আমরা জন্মেছি। আয়ুর উপরে আমাদের হাত নেই, কিন্তু আমরা শরীরকে যদি ঠিকভাবে ‘নার্চার’ করতে পারি, তাহলে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার কোনও অসুবিধা নেই। তার জন্য কী করতে হবে?
খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখুন মাছ-টাটকা শাকসব্জি-ফলমূল-দই। তেল-ঘি হীন সুষম খাবার ঠিক সময়ে খান। তবে পরিমিত ভাবে। জাঙ্ক ফুড একবারেই নয়। আইসক্রিম-কোল্ড ড্রিঙ্কস এড়িয়ে চলুন। জীবন থেকে ছেঁটে দিন ধূমপান-সহ সব রকমের নেশা। মদ? চলতে পারে। তবে মেপে।
মেন্টাল ফ্যাকালটি ব্লান্ট হলে চলবে না। প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশুন, বই পড়ুন, টিভি দেখুন। হাসুন, মজায় থাকুন।
আর টেনশনমুক্ত থাকুন। খোলামেলা জায়গায় বাস করুন। এখন সংক্রমণ রোগ কমে যাওয়ায় মানুষের আয়ু অনেক বেড়ে গিয়েছে। নেশা না-করলে আরও ভাল থাকবেন।
পঞ্চাশ হলেই নিয়মিত লিপিড প্রোফাইল এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে নিতে দ্বিধা করবেন না। ক্যান্সার সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। শরীরে কোথাও কোনও অসঙ্গতি দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিজেকে নিয়মিত পরীক্ষা করান।

ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.