|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন ৩... |
|
ন হন্যতে ২ |
চাপা পড়া মানুষের রূপকথা। একেবারেই মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস নয়।
পরিচালক রিংগো বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বতন্ত্র ছবি। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় |
নামটাই যা ‘ন হন্যতে’। ওটুকু ছাড়া ১৯৭৪-এ প্রকাশ পাওয়া মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাসের সঙ্গে এ ছবির এক মিলিমিটারও মিল নেই।
মিল নেই ওঁর রোমানিয়ান প্রেমিক মির্চা ইলিয়াদের নভেলেরও। যে নভেলের ফরাসি ভার্সানটির নাম ‘লা নুই বেঙ্গলি’। রোমানিয়ান ভাষায় মির্চার উপন্যাসটি প্রকাশ পায় ১৯৩৩-এ। তার ঠিক আগেই ভারতে এসেছিলেন মির্চা। মৈত্রেয়ী তখন কিশোরী। রোমানীয় যুবক তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রণয়ের সম্পর্কে। সেই প্রণয়কাহিনিকেই ভিত্তি করেই মির্চার উপন্যাস। যদিও কল্পনার রং সেখানে বাস্তবের জমিটাকে অনেকটাই পালটে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী! সে উপন্যাস তখন হটকেক। অনূদিত হচ্ছে নানা ভাষায়। বহু পরে মির্চার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর ওঁর নভেলকে ঘিরে তাঁর অনুভূতি নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী লেখেন ‘ন হন্যতে’।
রিংগোর এ ছবির গল্প তাঁর নিজের। যদিও সেই গল্পের সূত্রটি একটি বিদেশি ম্যাগাজিনের ফিচার। জিয়াং লিং নামে এক চিনা ভদ্রমহিলার লেখা। ১৯৭৬-এ মারাত্মক ভূমিকম্পে চিনের তাংসেন-এ আড়াই লাখ মানুষ প্রাণ হারান। অকল্পনীয় ভাবে বেঁচে যান এই জিয়াং। রিংগো বলছিলেন, ‘‘ফিচারটা পড়ার পর একটা ধসে যাওয়া বাড়ির কাহিনি হঠাৎই ক্লিক করে। ভাঙা বাড়ির নীচে চাপা পড়ার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশের সোনার গাঁ-এ শ্যুট করতে গিয়ে একটা বাড়ির বড় অংশ ভেঙে পড়ে আমার ওপর। তার পর থেকে আমার বাঁ পা’টা ‘রিপেয়ার্ড’।’’ |
|
টলিউডে ইনিংস শুরু সায়নীর |
ছবির গল্প অনেকটাই জুড়ে আছে চাপা পড়া মানুষের কাহিনি। ইদানীং বহু বাংলা ছবিতে যেমন কসমোপলিটন লোকজন ও তাঁদের মেট্রোপলিটন মনের জটিলতা নিয়ে গল্প আসছে, ঠিক তেমনটা নয়। বরং এ ছবি সরল নাগরিক জীবনের কাহিনি। কলকাতা থেকে বহু দূরের এক আধা শহর, আধা গ্রাম সমস্তিপুর। বিহারের নয়, কল্পনার সমস্তিপুর। ধু ধু ধান জমি, পাকা সড়ক, কাঁচা রাস্তা। দূরে টিলা। ছবি দেখার সঙ্গে কি ট্র্যাভেলগেরও প্যাকেজ! কিছুটা তো বটেই। পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের পাহাড়, বোলপুরের রাস্তাঘাট, এমনকী আকাশ থেকে ময়দানের সবুজ মখমলের ওপর জেগে থাকা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল...! এই সব কিছু নিয়েই রিংগোর ‘ন হন্যতে’ রিলিজ করতে চলেছে ১৬ নভেম্বর।
সমস্তিপুরে বেশির ভাগই মধ্যবিত্তের বসত। এলাকার এক প্রাসাদোপম বাড়িতে ভাড়ায় থাকে অনেক পরিবার। তাদেরই একজন দেবেশ। তাঁর স্ত্রী জুঁই। বছর চারেকের ছেলে রতন। তার বোন শিউলি। সোহাগ, খুনসুটি আর মিঠে দুষ্টুমির মিষ্টি সংসার। এক গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে, গোটা বাড়িটা তখন ভেঙে পড়ে। মারা যান দেবেশ। ধসের নীচে আটকা পড়ে রতন আর শিউলি। বহুক্ষণ পর দেখা যায়, বাঁচানো যাবে ওদের একজনকে। জুঁইকে রায় দিতে হয় কাকে তিনি বেছে নিতে চান, রতন না শিউলি? জুঁই বলে ওঠেন, ‘‘আমার ছেলেকে তোমরা বাঁচিয়ে দাও।’’ ঘটনা গড়াতে থাকে। কখনও সরল, কখনও বাঁকা পথে।
কাস্টিং-এ বড় মাপের চমক নবাগতা সায়নী দত্ত। সায়নী এখানে বড় বয়সের শিউলি। সায়নীর অন্য পরিচয়, উনি প্রতিবাদী পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তর মেয়ে। সেখানে এক আশ্চর্য সমাপতন! - ছাত্রাবস্থায় সুভাষ ছিলেন নিম্নমেধার। বাংলা মিডিয়ামের ইংরেজিতে ফেল করা ছাত্র। পরে এই ছাত্রই কিনা সুপ্রিম কোর্টে ইংরেজিতে সওয়াল করে দেশে প্রথম গ্রিন বেঞ্চ চালু করেন! রূপকথা! শিউলির জীবনটাও তো তেমনই। রূপকথার। প্রতিবাদেরও। সায়নী প্রথাগত সুন্দরী নন, কিন্তু জ্বলজ্বলে ছিপছিপে, নির্মেদ শরীর। গভীর চাউনি। নিখুঁত ছন্দবিন্যাসে সংলাপ বলেন। সংলাপের বাইরেও ওঁর নির্বাক অভিনয় দেখে মনে হতেই পারে লম্বা রেসের ঘোড়া।
জুঁই করছেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। জীবনের যখন পাড় ভাঙে তখন জুঁই কঠোর, রুক্ষ। সে পাড়ে যখন জোড়া লাগে তখন তিনি শান্ত, অন্তর্মুখী। জুঁইয়ের জীবনের নানা শেডকে অনায়াসে ধরেছেন রূপা। ওঁর দাপট অনেক সময় ‘পার’-এর শাবানাকে মনে করিয়ে দেয়। বড় বয়েসের রতন হয়েছেন রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়। আধখ্যাপা, সাদাসিধে, একটা হাত অকেজো রতনের। পুরোদস্তুর গ্ল্যামারহীন। কিন্তু শুধু অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে বহু সময়ে আলো ছড়িয়েছেন রাহুল। দেবশঙ্কর হয়েছেন মোরশেদ। মোরশেদ কখনও দায়িত্ববান স্বামী, কখনও স্নেহময় পিতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেবশঙ্কর ওঁর স্টেজ-পারফরম্যান্সের মতোই শার্প।
ন্যাচারাল অ্যাকটিং আর ভাঙা বাড়ির শট এ ছবির ইউ এস পি। তবে কাহিনি কিছুটা বা দীর্ঘ, অনিবার্যতায় ভরা। অতিনাটকীয়ও। আলোর ব্যবহার, মেকআপ কখনও বা দৃষ্টিকটু, কিন্তু জীবনের সারল্য থেকে ছবির ফোকাস কখনও হারায় না। এ ছবির স্পিরিট, বলা ভাল অন্তরাত্মাই - ন হন্যতে — যার মৃত্যু নেই। মৃত্যু নেই চেতনার, অনুভবের, আর্তির। আবার এ ছবি নানারকম মায়েরও গল্প। দাবি পরিচালকের। সেই মায়ের তালিকায় যেমন জুঁই আছেন, তেমন আছেন শিউলির আশ্রয়দাত্রী জোহা। আছে এক কুমারী মা। আবার আছেন আরেক মা। যে মা কি না ছুটে আসা আগুনকেও ভয় না পেয়ে দুর্ঘটনার পরে রাস্তায় পা গেঁথে যাওয়া মেয়েকে আগলে বসে থাকেন। যে করে হোক, উদ্ধারের আশায়। এও তো সেই স্পিরিটের কাহিনি? অন্তরাত্মার?
- ন হন্যতে! |
|
|
|
|
|