একজনের বয়স ১৭ আর এক জনের বড় জোর ১৫। স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি পিঠোপিঠি দুই বোনের কেউই। তবে ডোমকলের গরিবপুর গ্রামের মফেজউদ্দিন মনে করেছিলেন মেয়েরা বিয়ের যোগ্যা হয়ে গিয়েছে। তাই নুন আনতে ভাত ফুরনো সংসারে একই সঙ্গে দুই মেয়ের জন্য দু’জন ভাল পাত্রের সন্ধান পেতেই তাঁর মনে হয়েছিল এতদিন পরে বোধহয় আল্লা তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তবে নাবালিকা দুই মেয়ের বিয়েতে প্রতিবেশীরা আপত্তি তুললেও সে কথা তখন কানে তোলেননি মফেজউদ্দিন। একই দিনে দুই মেয়ের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে যাবতীয় আয়োজনও সেরে ফেলেছিলেন তিনি। সেই মতো বৃহস্পতিবার উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে জমজমাট ছিল বিয়ে বাড়ি।
জোড়া বিয়ে বলে কথা তাই ব্যস্ততাও ছিল তুঙ্গে। উঠোনের এক কোণে উনুনে চলছিল রান্নাবান্না। বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনরাও চলে এসেছিলেন সকাল সকাল। দু’বোনকে কনের সাজে সাজাচ্ছিল তাদের বয়সেরই পাড়ার কয়েকজন মেয়ে। এরপর গ্রামের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে বাড়ির সামনে আচমকা গাড়িটা থামতেই শোরগোল পড়ে যায় বিয়ে বাড়িতে ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ বলে। কয়েকজন ছুটে বাড়ির বাইরেও এসেছিলেন কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুল ভাঙল বর নয়, গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে কয়েকজন পুলিশকর্মীকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন প্রশাসনের কর্তারা। সঙ্গে ছিলেন গরিবপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের পরমানন্দ অধিকারীও। এরপর প্রশাসনের কর্তারা মফেজউদ্দিনকে বুঝিয়ে দুই নাবালিকা মেয়েরই বিয়ে বন্ধ করে দেন। ‘মেয়েরা সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিয়ে দেব না’, তাঁর কাছ থেকে এমনই মুচলেকা লিখিয়ে নেন প্রশাসনের কর্তারা। ছোট্ট একটা মুদির দোকানের মালিক মফেজউদ্দিন। তিনি বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। স্ত্রী, পুত্র ও দুই মেয়েকে নিয়ে কোনও মতে দিন চলে। অতশত নিয়মও আমি জানতাম না। মেয়েদের কী করে বিয়ে দেব, এটাই আমার সব থেকে বড় চিন্তা ছিল। তারপর একসঙ্গে দুই মেয়ের জন্যই ভাল পাত্রের খোঁজ পেতেই আর কিছু ভাবিনি। তবে প্রশাসনের লোকজন আমাকে ভাল করে সব কিছু বলতেই আমিও ঠিক করেছি যে প্রাপ্তবয়স্কা হলে তবেই মেয়েদের বিয়ে দেব।”
ওই দুই নাবালিকা বোনের একজন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। অন্য জন পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। তাদের কথায়, “বাবা খুব কষ্ট করেই আমাদের মানুষ করছে। তাই ইচ্ছে না থাকলেও বাবার বিরুদ্ধেও কথা বলতে পারিনি। এখন প্রশাসনের লোকজন বাবাকে বুঝিয়েছে, বাবাও রাজি হয়েছে। আমরা আবার আগের মতো বান্ধবীদের সঙ্গে এক সঙ্গে স্কুলে যেতে পারব ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে।” মুর্শিদাবাদে প্রশাসনের উদ্যোগে নাবালিকার বিয়ে রুখে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে একই সঙ্গে একই পরিবারের দুই নাবালিকা বোনের বিয়ে বন্ধের ঘটনা নজিরবিহীন বলেই দাবি প্রশাসনের। ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “ঠিক সময়েই খবরটা আমাদের কানে এসেছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গেই ডোমকলের যুগ্ম বিডিও রঘুনাথ দাশ ও বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মীকে ওই এলাকায় পাঠিয়েছিলাম।” ডোমকলের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম গরিবপুরের বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। শিক্ষিতের হার মেরেকেটে ২০ শতাংশ। যানবাহন বলতে যন্ত্রচালিত রিকশা, সাইকেল ও ভ্যান। পঞ্চায়েত প্রধান পরমানন্দ অধিকারী বলেন, “এই গ্রামে এরপর যাতে আর কেউ নাবালিকা মেয়ের বিয়ে না দেন, তার জন্য আমরা গ্রামের মানুষকে সচেতন করার কাজ শুরু করেছি।” তিনি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই স্বনির্ভরগোষ্ঠীর মহিলা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যদের নিয়ে একটা আলোচনা করেছি, তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বোঝাবেন। সেই সঙ্গে হ্যান্ডবিল বিলি ও মাইকেও প্রচার চালানো হবে।” |