শান্ত জঙ্গলমহলে উৎসবের ধুম
নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই কাজল মাহাতোর। হেঁসেল সামলে গোয়াল ঘর সাজানোর কাজে জোর ব্যস্ত ঝাড়গ্রামের ধোবাধোবিন গ্রামের এই বধূ। সামনেই যে বাঁদনা পরব। জঙ্গলমহলের মূলবাসীদের বিশ্বাস, কালীপুজোর রাতে মর্ত্যলোকের প্রতিটি গোয়াল পরিদর্শনে আসেন স্বয়ং মহাদেব। তাই নোংরা ঝেঁটিয়ে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে গোয়ালঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। মাটি লেপে গোয়ালঘর মুছতে-মুছতে কাজলদেবী বলেন, “গত তিন বছর অশান্তির কারণে উৎসবের আনন্দে ভাটা পড়েছিল। পরিস্থিতি পাল্টেছে। এ বার দারুণ ধুম হবে।”
মাহাতো ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ‘বাঁদনা-পরব’ আসলে আমন চাষের শেষে গরুগাভীদের বন্দনা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতে, “বন্দনা থেকে কিংবা বন্ধন থেকেও ‘বাঁদনা’ শব্দটা এসে থাকতে পারে। কারণ পরবের শেষ দিনে খুঁটিতে গরুদের বেঁধে রেখে শারীরিক কসরৎ করানো হয়।” কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাত থেকে শুরু হওয়া বাঁদনা পরব শেষ হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন। কালীপুজোর রাতে গান শুনিয়ে গরুর সেবা করা হয়। প্রতিপদের দিন হয় গোয়াল পুজো আর দ্বিতীয়ার দিন পরবের অন্তিম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘গরু খোঁটান’।
বাঁদনা-পরবে গো-বন্দনা। —ফাইল চিত্র।
গত কয়েক বছর ধরে বোমা-গুলির লড়াইয়ে কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছিল উৎসবের আলো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বার জাঁক যেন একটু বেশি। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট ঝুমুর গায়িকা ইন্দ্রাণী মাহাতো বললেন, “বাঁদনা পরব উপলক্ষে এ বার প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে অনেক বেশি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছি। পরবের দিনগুলিতে আমার ঠাসা কর্মসূচি।” তিনি আরও বলেন, “দুর্গাপুজোয় আমাদের নতুন পোশাক হয় না। বাঁদনা পরবেই আমরা নতুন জামাকাপড় পরি।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, এই উৎসবের নানা অঙ্গ আছেযা জঙ্গলমহলের একান্তই নিজস্ব। লালগড়ের বড়পেলিয়া গ্রামের তপন মাহাতো বললেন, “মহুল গাছের কড়চা ফল ও তিল একসঙ্গে পিষে যে তেল হয় তা দিয়েই প্রদীপ জ্বালানো হয়। ওই তেল গরুর শিঙেও মাখানো হয়।” শুক্রবার তিল ও কড়চা ফল পেষাই করার জন্য লালগড় বাজারের একটি তেল পেষাই কলে এসেছিলেন তপনবাবু। তাঁর মতোই আরও অনেক গ্রামবাসী আগে ভাগেই তেল তৈরি করে রাখছেন। কেউ কেউ আবার বাজার থেকেই সরাসরি তেল কিনে নিচ্ছেন। লালগড়ের আজনাশুলি গ্রামের বাসিন্দা শিশির মাহাতো জানালেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বার উৎসব পালনের জন্য গ্রামে গ্রামে সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছে।” জঙ্গলমহলের বাজার হাটে নতুন মাটির হাঁড়ি, সরা, মাটির প্রদীপের পাশাপাশি, কুলো, ঝুড়ি কেনাকাটা চলছে। উৎসবের আগে থাকতেই এলাকাবাসীর মুখে মুখে ফিরছে বাঁদনা পরবের গান, “কনও নদী বহে হবকি ডবকিয়া কনও নদী বহেই নিরাধার/ কাঁসাই নদী বহে হবকি ডবকিয়া সবন্নখা বহে নিরাধার।”
নানা পর্যায়ে পালিত হয় বাদনা পরব। কালীপুজোর রাতে গান শুনিয়ে গরুকে ‘জাগানো’ হয়। ঢোল, মাদল, বাঁশি বাজিয়ে লায়ার (পূজারী) বাড়ি থেকে বেরোয় ‘ঝাঁগোড়’ বা জাগরণী গানের দল। গ্রামের সব বাড়ি থেকে অন্তত একজন করে পুরুষ এই দলে থাকেন। এই দলটি প্রত্যেক গৃহস্থের গোয়াল ঘরে গিয়ে গান করে। ধোবাধোবিন গ্রামের কালীচরণ মাহাতো শোনালেন জাগরণী গানের কথা, “জাগে মা লক্ষ্মী জাগে মা ভগবতী, জাগে তো অমাবস্যার রাতি/ জাগে তো প্রতিপদ দেবে গো মাইলানি, পাঁচ পুতাঞঁ দশধেনু গাই।”
ঝাড়গ্রামের জোড়াখালি গ্রামের প্রৌঢ়া সুমিত্রা মাহাতো ও তাঁর বউমা রীতা মাহাতো ঢেঁকি সাফ সুতরো করছিলেন। সুমিত্রাদেবী বললেন, “অমাবস্যার রাতে বাড়ি-বাড়ি ‘ঝাঁগোড়া পিঠা’ বানানো হয়। জাগরণের গানের দলকে গৃহস্থেরা সেই পিঠে খেতে দেন। গরুকেও পিঠে খাওয়ানো হয়। পিঠে বানানোর জন্য কেবলমাত্র ঢেঁকিতে কোটা চালের গুঁড়ি লাগে।”
প্রতিপদের দিন সকালে হয় ‘গোয়াল পূজা’। এ দিন চালগুঁড়ির সঙ্গে পাইনা লতা নামে জঙ্গলের এক ধরনের পিচ্ছিল লতা বেটে উঠোনের দরজা থেকে গোয়াল ঘর ও প্রতিটি ঘরের সামনে আলপনা দেওয়ার রীতি রয়েছে। আলপনার মধ্যে দেওয়া হয় সিঁদুরের ফোঁটা। গোয়াল ঘরের এককোণে তিনটি কাঁচা মাটির মণ্ডর মধ্যে ডাঁটা সমেত তিনটি সাদা শালুক ফুল রাখা হয়। গৃহপালিত পশুদের মঙ্গল কামনায় নিবেদন করা হয় আতপ চাল ও ফল-মিষ্টির নৈবেদ্য। ব্যাঘ্রদেবতা বা ‘বাঘুত’-এর সন্তুষ্টির জন্য কেউ কেউ গোয়াল ঘরে পাঁঠা বা মোরগ বলি দেন। সেই সঙ্গে চাষের উপকরণ--- লাঙল, জোয়াল, মই ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা হয় বাড়ির উঠোনের তুলসী তলায়। বাড়ির মহিলারা স্নান করে ভিজে কাপড়ে গোয়াল ঘরের মধ্যেই উনুন বানিয়ে মাটির মালসায় পিঠে বসান। চালগুঁড়ি, আখের গুড় ও দুধ দিয়ে মেখে এক হাতা করে গরম ঘিয়ে ভেজে তোলা হয় এই ‘গরৈয়া পিঠা’। সাধারণত ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে বাঁদনা পরবের শেষ পর্যায় ‘গরু খোঁটান’ অনুষ্ঠিত হয়। শালবল্লিতে বেঁধে রাখা বলদ বা এঁড়ে গরুদের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মৃত মোষের চামড়া। বলদ বা এঁড়ে গরুগুলো যখন ওই চামড়া গোঁতাতে যায়, বেজে ওঠে ঢাক, মাদল। হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে সমবেত জনতা। ‘গরু খোঁটানে’র সময় সমবেত গান করা হয়, “এতদিন চরালি ভালা, কোচাখুঁদি রে, আজ তো দেখিব মরদানি/ চার ঠেঙে নাচবি, দুই শিঙে মারবি, রাখিবি বাগাল ভাইয়ের নাম.....।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.