|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
ফিউশনের ফোঁটা
ঋজু বসু |
|
ভাইফোঁটা ছাপ গোলাকার সেই সন্দেশ আস্ত সাঁটানোটা বোধহয় ত্রেতা যুগের ভাইদের কম্মো! এই একুশ শতকের বং-প্রজন্মের পক্ষে অত বড় সন্দেশ কব্জা করাটা সোজা ব্যাপার নয়। তবু পাতে তাকে দেখতে না পেলে ভাই-বোন সক্কলেরই ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে।
তাই তিনিও অবশ্যই থাকবেন। কিন্তু একদা নায়ক সেই মহাসন্দেশকে সরিয়ে আপাতত নতুন তারকাদের জয়জয়কার। যেমন, বলরামে চেনা মালপো হঠাৎ মেপ্ল সিরাপে নেয়ে উঠেছে। নকুড়ের সন্দেশে কফি-স্বাদের আমদানি। আর নোনতায় শিঙাড়ার গর্ভে আমেরিকান কর্ন, ক্যাপসিকাম, চিজের সঙ্গে ভাজা মশলার ছোঁয়ায় তাক লাগিয়ে দিচ্ছে কে সি দাশ।
পরিবর্তন শব্দটা আজকাল ক্লিশে লাগে ঠিকই, কিন্তু এ ছাড়া আর জুতসই কী বলা যায় বলুন! ধ্রুপদী মিষ্টির ঠেক নকুড় বা বলরাম এই ভাইফোঁটায় মোটেও তাদের পুরনো সৃষ্টির ভরসায় বসে নেই। ঘিয়ে ভাজা খাজা বলরামে জুটলেও চকোলেট মোড়া বাদামের বরফির জোরেই তারা এ বাজারে লড়াইয়ের ময়দানে জঙ্গি। নকুড়ের কাজুবাদামবাটা ভরপুর চকোপুলি সন্দেশ খেয়ে কোনও প্রাচীনপন্থীর বুকে হয়তো ধাক্কা লাগবে। না জেনে উত্তর ভারতের হালুইকরের সৃষ্টি ভেবেও ভুল হতে পারে। তবু এই সব নানা কিসিমের দেশি-বিদেশি স্বাদের ফিউশনই বাঙালির গর্বের মিষ্টি প্রতিষ্ঠানেও লক্ষ্মী হয়ে ধরা দিয়েছে। কে সি দাশ তাদের নতুন শিঙাড়ার নাম দিয়েছে শিঙাড়া ইতালিয়ানো। দামে কিঞ্চিত উঁচকপালে হলে কী, এ বস্তুটি এখন জটায়ুর ভাষায় সেলিং লাইক
হট কচুরিজ। |
|
এমন নয় যে পুরনো সৃষ্টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ ভাইফোঁটায় নকুড়ে নারকোল-ঠাসা মৌসুমির চকোলেট-সংস্করণ কোকো চকোলেট বা আমসত্ত্ব ভরপুর আম্রপালীর দাপট। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই প্রবাদপ্রতিম, নানা স্বাদের সর-মোড়া মালাই রোলও আছে। মাঝে কারিগরির ঝামেলায় নকুড় এই সর ‘আউটসোর্স’ করত। এখন তারা নতুন উদ্যমে বাড়তি তরিবত করে এই সর সৃষ্টিতে মেতেছে। ফলে স্বাদটা আরও খোলতাই।
কলকাতায় নতুন সৃষ্টির ঝোঁকে বলরামের ছটফটানিতেও মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। প্রতি বারই নতুন নতুন কোনও কসরতে তারা তাক লাগিয়ে ছাড়বে। এ বার সেখানে অবাঙালি দোকানের পেটমোটা মালপোর চেহারা দেখে একটু রাগই হয়েছিল। কিন্তু মুখে দিতেই চমৎকার! সেই মাসিমার মালপুয়ার মৌরির স্বাদটা নেই ঠিকই, কিন্তু ঘিয়ের সুঘ্রাণে আমেজে ভেতরটা ঠাসা ছানা। আর সঙ্গে চিনির রসের বদলে মেপ্ল সিরাপ। ফলে মিষ্টিটা তত চড়া নয়। সাহেবি প্যানকেকের সঙ্গে এই সুমধুর মেপ্ল মধুই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মালপোর সঙ্গতে তা এমন মহিমান্বিত হবে, কে জানত।
|
|
গোলাপজল মেশানো ক্রিম অব রোজ সন্দেশের প্রতি কামড়েও বিস্ময়। সাবধান না হলে ভরপুর তরল হোয়াইট চকোলেট ভাইদের নতুন পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দেবে। ব্ল্যাক কারান্ট সন্দেশ বা আনারস আনন্দও মার্জিত মিষ্টি। চাপে পড়ে সংযম অনুশীলনকারী ভাই-বোনেদের জন্য অনুকূল। নকুড়ও আনারসের গোল্ডেন পাইনঅ্যাপ্ল নামাচ্ছে।
বলরাম আবার জিভের মধ্যে জড়িয়ে থাকা বেক্ড মিহিদানা এবং মিহিদানা ঠাসা পেল্লায় শঙ্খেও এই ভাইফোঁটাকে নিশানা করছে। তাদের আরও একটি সার্থক ফিউশন, চন্দ্রপুলি ও সন্দেশের যুগলবন্দি চন্দ্রনাড়ু। বিশুদ্ধ নিরামিষ আনারসময় ছানার পুডিংও স্মরণীয়।
|
|
একদা বাঙালি ময়রা লেডি ক্যানিংয়ের আগমন উপলক্ষে লেডিকেনি বানিয়েছিলেন। চন্দননগরের তেলিনিপাড়ার জমিদার-বাড়ির ফরমায়েশে সৃষ্টি হয়েছিল জলভরা তালশাঁসের। এখন নতুন সৃষ্টির নেপথ্যে তেমন প্রেরণা কম। কিন্তু বছরের এক একটা লগ্ন গুরুত্বপূর্ণ। পুজোর গান, নাটক, সিনেমার সে দিন আর নেই। কিন্তু পুজো, ভাইফোঁটা, রথযাত্রা, দোলের নতুন মিষ্টি স্বমহিমায়। নতুন সব মিষ্টি সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনিও জমজমাট। যেমন নকুড়ের সদ্যোজাত মঞ্জরী। এ বার বিজয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছা জানাতে সন্দেশের তিন তলা কেক পাঠিয়েছিল নকুড়। তার এক তলায় পেস্তা, দু’তলায় সাদা সন্দেশ আর তিন তলায় জাফরান। ব্ল্যাক কারেন্ট সন্দেশের আইসিংয়ে শুভেচ্ছাবার্তাটি লেখা হয়। সেই কেকই এখন ছোট্ট সংস্করণে সন্দেশ হয়েছে। ভাইফোঁটার একটি
সেরা আকর্ষণ।
পুজোয় কে সি দাশের চমক ত্রিনয়নীরও আকর্ষণ ফিকে হয়নি। রসগোল্লার মতো ফোটানো ছানা ও কোকোর গুঁড়োর মিশেলে প্রতিমার চালচিত্রের আদল। তাতে জাফরান সন্দেশে প্রতিমার চোখ বসেছে। চালচিত্রের মাথায় স্ট্রবেরি সন্দেশের কারিকুরি। নতুন মিষ্টির ঝোঁক কলকাতা ছাড়িয়ে মফস্সলেও। রিষড়ার ফেলু ময়রার নিবেদন ব্লুবেরি স্বাদের নীলকান্তি সন্দেশ। তারা আম-সন্দেশের আকারের অভিনব রসগোল্লাও বানাচ্ছে। তাতে আমের জেলি ভরপুর।
সিমলে-নতুনবাজার-রাসবিহারীর নলিন, নতুনবাজার-বাগবাজার-মানিকতলার মাখন এবং ঝামাপুকুর-ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে যাদব দাশের কথা বাদ দিয়েও কলকাতার মিষ্টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে না। মাখনের অরেঞ্জ মনোহরার জবাব নেই। কমলারঙা শক্ত মোড়কের মধ্যে তুলতুলে পাক সন্দেশটি অনন্য। পুরনো মিষ্টিতে যাদবের আটাপাক ‘আবার খাবো’ও অবিসংবাদিত ভাবে কালজয়ী। ছানার সন্দেশের পেটে ক্ষীর-গরম মশলার স্বাদ। খেতে খেতে গলায় আটকে আটকে যায়। যথার্থ রসিক তাতেই মজাটা উপভোগ করবেন। |
|
থিমপুজোর ভিড়ে সাবেক ঠাকুরের মহিমা যেমন কেউ কেউ ভুলতে পারে না, তেমনই এই ভাইফোঁটাতেও কিছু সাবেক স্বাদও অমলিন। ফেলু ময়রার রাজকীয় কিন্তু নির্ভার গজা, লবঙ্গলতিকা খেলে ও সব মিষ্টি আর কোথাও মুখে তুলতে ইচ্ছে হবে না। একেলে ভাইরা কে সি দাশের বিজাতীয় শিঙাড়া বা বলরামের ছানার ক্রোকেটে মজতে পারেন, কিন্তু রিষড়ায় ফেলুর দোকান থেকে ঘিয়ে ভাজা খাস্তা নিমকি বা গুটকে কচুরি আনিয়ে দেখুন। গুটকে কিছুটা চ্যাপ্টা খাস্তা কচুরির মতো দেখতে। মিহি পাতলা খোলে ছাতুর সঙ্গে আদা-গোলমরিচ-লঙ্কার চিরচিরে ঝাল পুর। মাইক্রোআভেনে গরম করে বাসি খেলেও অমৃত। বিস্মৃত এই স্বাদ অন্যত্র খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটবে।
নতুনের ভিড়ে এমন কিছু কিছু ধ্রুপদী স্বাদও ফিরে ফিরে আসে। ভাইফোঁটায় অনেক দিন বাদে প্রবাস থেকে আদরের বোন বা ভাইটি যেমন ঘরে ফিরছে!
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|