ব্যাগ গুছিয়ে...
রাতজাগানিয়া সে অরণ্যে
কালীঝোরা বাজার থেকে এন এইচ-৩১এ ছেড়ে ডাইভারসনের মুখে লাল টুকটুকে গাড়িটা বাঁ হাতি ঘুরতেই মনে হল একটা লেডিবার্ড যেন উড়ে এল জঙ্গলের পথে। একটা সব কিছু মেশানো ভেজা গন্ধ উড়ে এল দমকা হাওয়ায়। এ গন্ধটা বুকের ভিতর সেঁধোলেই মনটা কেমন যেন ভাল হয়ে যায়। পথ ভেজানো নাম না জানা ঝোরা...ডান হাতে পাহাড়ি রাস্তার গা ঘেঁষে সীমানা উজিয়ে নেমে আসা এলাচ গাছের জঙ্গল...বাঁ দিকের খাদের ভিতর থেকে মাথা তুলে তাকানো অতলান্ত সবুজ...দোয়েলের শিস....হাল্কা ডানা মেলে ভেসে যাওয়া রঙিন প্রজাপতিরা! এদের ভিতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম মহানন্দা অরণ্যের অন্দরমহলে চার হাজার ফুট উঁচুতে ছোট্ট এক জনপদ লাটপাঞ্চারে, শিলিগুড়ি থেকে মাত্র ৪২ কিলোমিটার দূরে এক অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডালিতে।
গাড়ি থেকে নামতেই দেখি ‘থ্রি ইডিয়টস’ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পদম, সুনীল এবং বি সি রাই। এই তিন বন্ধুর প্রচেষ্টায় লাটপাঞ্চারে গড়ে উঠছে ‘হোম স্টে ইকোট্যুরিজম’ ব্যবস্থা। যে ঘরটায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সে ঘরে তিন জন দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যায়।
বারান্দায় দাঁড়ালে সামনের দু’-তিনটি বাড়ির নিচু ছাদ পার করে নজর মেশে দূরে। যেখানে পাহাড় আর জঙ্গলের শরীরের ঢেউ। শেষ রাতের পাহাড়ি কুয়াশার বুনোট কেটে হাল্কা রোদে এখন স্বচ্ছ সে শরীর। তত ক্ষণে গরম এক পেয়ালা চা এসে গেছে। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি তাকে। বন্ধুবর কৌশিক দেউটির মুখে শোনা, লাটপাঞ্চার হল পাখি আর প্রজাপতির স্বর্গরাজ্য, মনে পড়ে গেল। আমার কিন্তু এক দর্শনেই মনে হয়েছে এখানে আকাশ আছে, ফুলের গন্ধ আছে, ভোরবেলাকার বাতাস আছে, চাঁদভাসি রাত আছে আর এমন আরও অনেক কিছু আছে যাদের মাঝে থাকা যায় শুধুই আনন্দে।
তবে ঠিক এই মুহূর্তে প্রচণ্ড খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। একটা দুর্দান্ত মধ্যাহ্নভোজ। খাবার শেষে আধ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রাইয়ের সঙ্গে হাঁটা দিলাম নামচি লেকের উদ্দেশে। চার কিলোমিটার পথ উজিয়ে নামচিতে যখন পৌঁছলাম আকাশের মুখ ভার। ‘লেক প্ল্যাসিড’ ছবিটা যাঁরা দেখেছেন তাঁরা এর সঙ্গে অনেকটা মিল খুঁজে পাবেন। কোনও পাখিরও ডাক শুনছি না। নৈঃশব্দ্য যেন গিলে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই যেন লেকের জল থেকে সিনেমার সেই বিরাট কুমিরটার মতো একটা কুমির ঝপ করে উঠে আসবে। তিন দিক ঘেরা জঙ্গল বেয়ে মেঘ কুয়াশা ধীরে ধীরে নামছে লেকের জলে। বেশ গা ছমছমে ভাব।
লেকের পাশে নিচু ঘাসের জঙ্গল ভেঙে ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন প্রজাতির ফড়িং, গেছো ব্যাঙের দেখা পেলাম। আর পেলাম পুরনো কেটে রাখা কাঠের গুঁড়ির তলায় মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা ‘স্যালামান্ডার’। ফিরছি যখন তখন আকাশের কালো মেঘেরা একেবারে কাজলকালো। দু’-চার ফোঁটা জল গায়ে-মাথায় নিয়ে আমার আশ্রয়ের বারান্দায় এসে পৌঁছলাম। চেয়ার টেনে বসলাম সেখানে, একা। কাজলকালো মেঘেরা হঠাৎই ভেঙে পড়ল লাটপাঞ্চারের মাথায়। দমকা হাওয়া...জঙ্গল, পাহাড় প্রবল বৃষ্টির চাদরে মুড়ি দিল। হুঁশ ফিরল পদমের ডাকে, ‘চায় লিজিয়ে সাব’। চা খেতে খেতে পদমের সঙ্গে কালকের সারা দিনের একটা প্রোগ্রাম করে রাখি।
রাত তখন কত হবে কে জানে। ঢং ঢং করে বাজা ঘণ্টার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। ভাবলাম ভোরে মন্দিরের ঘণ্টা বাজছে। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি থেমেছে। ঘড়িতে দেখি রাত ৩টে ৪৫। কোনও এক রাতজাগা পাখি ডানা ঝাপটালো। কালীঝোরাও নিশ্চয়ই তার বুকে শেষ রাতের হিমকে ওম দিচ্ছে। মন্দির নয়, ঘণ্টা বাজছে নীচের সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশনের অফিসে। দু’-চার জন করে লোক চলছে রাস্তায়। অফিসের দিকে। আমি আর একবার বিছানা নিই।
পর দিন সকালে আবারও হাঁটা শুরু। আজকের যাত্রা ৫ কিমি পথ পার হয়ে লাটকুঠি। বনবিভাগের অফিস, বাংলো। তা পার হয়ে মহানন্দা অরণ্যের ভিতরে ঢোকা। তবে বেশি নীচে নামা নয়। কারণ নীচে হাতির পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গতকাল বৃষ্টির পর আজ রোদ উঠেছে। বেশ একটা ভাললাগা আমেজ নিয়ে পথ চলা শুরু করলাম। পথের দু’ধারে অজস্র ছোট বাঁশ, এলাচ, পাইন, অর্কিড আর সিঙ্কোনা গাছের ভিড়। ঝিঁ ঝিঁ ডেকে চলেছে এক সুরে। বুলবুল, ফিঙে আর নানান রঙের মিনিভেট পাখির ভিড় আর হইচইতে চারপাশ সরগরম। কাল বৃষ্টিতে ডাকতে পারেনি বলেই আজ যেন সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে চাইছে। পড়ে থাকা পুরনো গাছের গুঁড়িতে কমলারঙা ছত্রাক। ভেজা জমি থেকে মাথা তুলছে দু’-চারটে ছোট জোঁক। প্রজাপতিরা ছটফটে।
লাটকুঠি পার হয়ে মহানন্দা অরণ্যের ভিতর বেশ কিছুটা নামার পর একটা জলাশয়। সেখানেও কিছু নতুন গেছো ব্যাঙের দেখা মিলল। এ অরণ্যে হারিয়ে যেতে হয়। ফিরতি পথে ‘হর্নবিল নেস্ট’-এর খোঁজে আবারও অভিযান। জঙ্গল পথে আবারও নেমে চলা। আরও গভীরে। রোদ্দুর ঢুকছে না তেমন। গাছপালার হাজার হাজার ডাল কালচে সবুজ অন্ধকার আর ধূসর পটভূমিতে আশ্চর্য রকমের কম্পোজিশন আর ফ্রেমিং তৈরি করেছে। প্রায় প্রতি পদক্ষেপে সুন্দর করে বোনা মাকড়সার জাল আর হরেক রকমের মাকড়সা। উডস্পাইডারই সব থেকে বেশি। এদের পার করে পৌঁছলাম যেখানে সেখানে বড় বড় চ্যাপ্টা দুটো পাথর। বসলাম তাতে। সামনের গাছটার প্রায় মাঝামাঝি অংশে ধনেশ পাখি বাসা বানিয়েছে কোটরে। ক্যামেরার জুম লেন্সে দেখলাম সে বাসা এখন খালি। প্রায় দু’ঘণ্টা সেখানে অপেক্ষার পর দেখা মিলেছিল তার। লেন্সবন্দি করেছিলাম তাকে। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান হর্নবিল’। সবুজের মাঝে কী দৃপ্ত চেহারা! নিমেষে মনটাকে সতেজ করে দিল।
সারা দিন প্রচুর হাঁটাহাঁটির পর ক্লান্ত দেহ আর সতেজ মন নিয়ে বাসায় ফিরে বারান্দার চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই চোখ বুজে এল। ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা পড়ে এসেছে। আমার জ্বালাধরা চোখের সামনে সন্ধ্যা নামছে। পাইনের ফুলগুলো শেষ সূর্যের নরম আলো আঙুলে ছুঁইয়ে বিদায় নিয়েছিল। বাইরের সেই ডানামোড়া নরম সোনালি পাখির মতো শেষ বিকেলের আলোটা কমে আসছিল ধীরে ধীরে। দূরে জঙ্গলের ভিতরে ধনেশটা ডাকছিল মাঝে মাঝে। অন্ধকার গাঢ় হল। চাঁদভাসি রাত। বর্ষা শেষের বন আলোয় আলো। তাকিয়ে রইলাম সে আলোর দিকে। আমার নিজেকে ফিরে পাওয়া বোধহয় এ বার অসম্পূর্ণই রয়ে গেল।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি বাসে বা ট্রেনে। ৯টা-সাড়ে ৯টার মধ্যে শিলিগুড়ির বিশাল সিনেমার
কাছ থেকে শেয়ার জিপ ছাড়ছে লাটপাঞ্চারের। অন্যথায় শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি।
কোথায় থাকবেন

এখানে ‘হোম স্টে’ পদ্ধতিতে থাকা-খাওয়ার বেসরকারি ব্যবস্থা।
লাটকুঠি বনবাংলোয় থাকতে গেলে বনবিভাগে যোগাযোগ করতে হবে।
কখন যাবেন
অক্টোবর থেকে এপ্রিল সব থেকে ভাল সময়। শীতে গেলে প্রয়োজনীয় গরম জামাকাপড় নিয়ে যাবেন।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.