|
|
|
|
দুবরাজপুর-কাণ্ড |
ফরেন্সিক তদন্ত শুরু হয়নি দু’দিন পরেও |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
দুবরাজপুর-কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বুধবার। তার পরে দু’দিন কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত শুরু হয়নি ফরেন্সিক তদন্তের কাজ। ঘটনার তিন দিন পরেও ফরেন্সিক তদন্ত না হওয়ায় কতটা প্রামাণ্য তথ্য ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যাবে, তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে পুলিশ মহলে। শুধু তাই নয়, ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার যে দু’টি কার্তুজ মিলেছিল, তার ব্যালিস্টিক পরীক্ষাও হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী গুলিচালনার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করার পরে পুলিশ এখন আর কার্তুজ পড়ে থাকার বিষয়টিই স্বীকার করছে না।
দুবরাজপুর-কাণ্ডের তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই মমতা এবং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় চারটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন। সেগুলি হল:
১. মঙ্গলবার লোবা গ্রামে গুলি চলেনি।
২. গ্রামবাসীদের কোনও দোষ নেই।
৩. মহাকরণে অভিযানের কোনও খবর ছিল না।
৪. সিপিএম-কংগ্রেস এবং অতি বাম একটি দল চক্রান্ত করে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
এর পরে বুধবার রাজ্য পুলিশ কর্তাদেরই একাংশ প্রশ্ন তুলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী এবং শিল্পমন্ত্রী এই কথা বলার পরে তদন্তের আর কী প্রয়োজন! আর এখনও ফরেন্সিক দল ঘটনাস্থলে না পৌঁছনোয় এ বার প্রশাসনিক তদন্তের হাল নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
যে সব ঘটনায় গুলিচালনার অভিযোগ ওঠে, সেখানে ফরেন্সিক তদন্ত সাধারণত দু’ভাবে হয়।
হয় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন, নয়তো পুলিশ নমুনা সংগ্রহ করে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠায়। দুটি ক্ষেত্রেই তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ফরেন্সিক দফতরকে লিখিত অনুরোধ জানায়। লোবা গ্রামের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই হয়নি। রাজ্য ফরেন্সিক দফতরের এক কর্তা বলেন, “পুলিশ আমাদের ওই ঘটনার তদন্ত সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। নিয়ম হল, ঘটনার পরে যত দ্রুত সম্ভব ফরেন্সিক তদন্ত শুরু করতে হয়। না হলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। এর পরে আমরা তথ্যপ্রমাণ পাব কোথায়?”
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের এডিজি আইনশৃঙ্খলা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে প্রশাসনিক তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত সুরজিৎবাবু ঘটনাস্থলে গিয়ে উঠতে পারেননি। গুলিচালনার অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, এডিজি পুলিশের বিভিন্ন মহল থেকে খবর সংগ্রহ করছেন। রাজ্য গোয়েন্দা এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা রিপোর্টও খতিয়ে দেখছেন। তার পরে তিনি যা করণীয়, করবেন। পুলিশের গুলিচালনার অভিযোগটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। তবে তার সম্ভবনা কম বলেই মনে করছেন অনেকে।
লোবা গ্রামের কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতারা এ দিন কলকাতায় এসে ফের অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার পুলিশই প্রথমে আক্রমণ চালিয়েছে। গুলিও ছুড়েছে পুলিশ। গুলিতেই আহত হয়েছেন তিন জন।
এ দিন সিউড়ি হাসপাতালে গিয়েছিলেন কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর কাছেও একই অভিযোগ করেছেন আহতরা। মঙ্গলবার ঘটনার পরে বীরভমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় গুলি চলার কথা স্বীকার করেছিলেন। এ দিন তিনি এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নেরই জবাব জিতে চাননি। মহাকরণে তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টি আমি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি। তিনি বিষয়টা দেখবেন বলেছেন।”
স্থানীয় মানুষের রাজ্য সরকারের উপরে সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে দাবি করেছেন শতাব্দী।
লোবা গ্রামের ঘটনার দায়ে বীরভূমের পুলিশ সুপারকে যে ভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্য পুলিশ মহলে তা নিয়েও বিতর্ক চলছে। এমনকী, কোনও পুলিশ কর্তা অভিযানের বিষয়টি রাজ্য পুলিশরে ডিজি-কে জানিয়েছিলেন বলেও কোনও কোনও সূত্রে বলা হচ্ছে। ওই সব অভিযোগই রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর অস্বীকার করেছে।
মহাকরণে এসে পৌঁছনো বিভিন্ন সূত্রের খবরে মাওবাদীদের যোগাযোগের বিষয়টিও রয়েছে। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের দুমকা ও পাকুড়ের দিকে আশ্রয় নেওয়া মাওবাদীদের বীরভূম স্কোয়াডের সদস্যরা গণ্ডগোলের আগে দুবরাজপুরের ওই গ্রামে ঢুকে পুলিশকে প্রতিরোধ করার বিষয়ে বাসিন্দাদের সাহায্য করেছিল। মূলত, রাজনগর, কাঁকরতলা ও দুবরাজপুর এই তিনটি থানা এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে তলে তলে ঘাঁটি গেড়ে থাকা মাওবাদীরা ও ঝাড়খণ্ড থেকে আসা তাদের কয়েক জন নেতা এর সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক ভাবে সন্দেহ করছেন গোয়েন্দারা।
দুবরাজপুর-সহ তিনটি থানা এলাকার পাথর খাদান ও পাথর ভাঙা কলের মালিকদের কাছ থেকে মাওবাদীরা নিয়মিত তোলা আদায়ও করে বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। তাঁদের দাবি, ওই সব এলাকায় বেআইনি ভাবে যারা কয়লা তোলে, তাদেরও রোজগারের একটা অংশ মাওবাদীদের দিতে হয়। মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেন, কলকাতার এমন কয়েক জন বিশিষ্টজনও গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে উস্কেছেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তবে মঙ্গলবার ভোরের ঘটনায় তাঁরা যে সরাসরি যুক্ত, সেই তথ্যপ্রমাণ পুলিশের কাছে নেই।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলছেন, ঘটনার পর দিন থেকে বাইরের প্রচুর লোক লোবা এলাকায় এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু মাওবাদীর আনাগোনাও তাঁরা লক্ষ করেছেন। আদিবাসীদের পাশাপাশি ঘটনার সময় অন্য গ্রামবাসীরাও প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে তির বেছে নেওয়ায় ধন্দে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তারা আপাতত তদন্ত করে জানার চেষ্টা করছে, ওই তিরের ভাবনা গ্রামবাসীরা পেলেন কোথা থেকে!
ওই দিন (গত ৬ নভেম্বর) ভোরে পুলিশ যে অভিযান করতে যাবে, তা স্থানীয় দুবরাজপুর থানা থেকেই কৃষিজমি রক্ষা কমিটি জানতে পারে বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্রের খবর। আগে থেকে খবর পেয়ে যাওয়ায় সতর্ক ছিল কমিটি। তাই ওই রাতে ধর্নামঞ্চে পাহারারত গ্রামবাসীর সংখ্যা ছিল ১৬। অন্যান্য দিন যেখানে থাকতেন মাত্র ৫-৬ জন।
অভিযানের খবর আগে জানতে পেরেছিলেন বলেই কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার সোমবার রাতেই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি সদর হাসপাতালে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ওই অভিযানে তাঁর উপরে চূড়ান্ত আক্রমণ হতে পারে, কিংবা অভিযানের পর কোনও মিথ্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসিয়েও দেওয়া হতে পারে। |
|
|
|
|
|