|
|
|
|
দুবরাজপুর কী চায়, এত দিনে শোনার উদ্যোগ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
জমির দরবৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘ দিনের ধর্না-অবস্থানের সময়ে যে উদ্যোগ চোখে পড়েনি, পুলিশি অভিযান ঘিরে বিতর্কের জেরে সেই প্রক্রিয়া শুরু হল। দুবরাজপুরের লোবায় আন্দোলনকারী ও ডিভিসি-এমটা’র মধ্যে আলোচনার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার আশ্বাস দিল রাজ্য সরকার।
পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পুততুণ্ডের সঙ্গে দুবরাজপুরের কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ন’জনের এক প্রতিনিধিদল শুক্রবার বিধানসভায় এসে দেখা করে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দলে ছিলেন কমিটির দুই নেতা জয়দীপ মজুমদার ও ফেলারাম মণ্ডলও। দুবরাজপুরের তৃণমূল ব্লক সভাপতি ভোলানাথ মিত্র ও লোবার পঞ্চায়েত প্রধান শেখ সফিক-সহ তৃণমূলের ১১ জনের এক প্রতিনিধিদলও এ দিন আলাদা ভাবে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতের কারণ অবশ্যই দুবরাজপুরে ‘বিতর্কিত’ পুলিশি অভিযান, তবে সেই অবসরে জমি-বিতর্ক মেটানোরও উদ্যোগ শুরু হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী বলেন, “গ্রামবাসীদের বক্তব্য জেনেছি। ডিভিসি-বেঙ্গল-এমটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সমস্যা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ওদের সঙ্গে ফের কথা বলব।”
গ্রামবাসী তথা কৃষিজমি রক্ষা কমিটির দাবি পরিষ্কার তাঁদের এলাকায় জমির নীচে যখন কয়লার ভাণ্ডার পাওয়া গিয়েছে, তখন সেই সম্পদের সম্ভাব্য মূল্য হিসেবে রেখেই জমির দাম ধরতে হবে। এত দিন ধরে ওই দাবিতে তাঁরা ধর্না চালিয়েছেন। ডিভিসি-এমটা’র মাটি কাটার একটা মেশিন আটকে রেখেছেন। গত বছর ডিসেম্বরে মহকুমাশাসকের নেতৃত্বে বৈঠক করে এই মর্মে সরকারি প্রস্তাব পাশ হয়েছে যে, কয়লা তোলার জন্য জমি চিহ্নিত না-করেই খনন শুরু করে এবং কাটা মাটি হিংলো নদীতে ফেলে সংস্থাটি অবৈধ কাজ করেছে।
এত কিছুর পরেও আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এ বার তার একটা আশা দেখা দিয়েছে। প্রশাসন ও রাজনীতিক মহলের একাংশের মতে, জমি নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানের ঘটনায় মমতার সরকার সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাওয়ার আশঙ্কায় শিল্পমন্ত্রী আলোচনার পথে পদক্ষেপ করেছেন। রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, “জমির নীচে কয়লা থাকায় বাড়তি দামের দাবি অযৌক্তিক কিছু নয়। মানলাম, বর্তমান সরকার জমি অধিগ্রহণে বিশ্বাসী নয়। তা-ও গ্রামবাসীদের দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থাটা তো করা যেত!” প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার মন্তব্য, “জমি অধিগ্রহণের ভার সরকার না-নিলে যে ধরনের সমস্যা হতে পারে, লোবায় তা-ই হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা নিজের মতো কাজ করেছে। রাজ্য সরকার মুখে গ্রামবাসীদের পাশে থাকার কথা বললেও আসলে কিছু করেনি!”
মমতার সরকার যে গ্রামবাসীদের ‘পাশে আছে’, সে দাবি অবশ্য এ দিনও করেছেন শিল্পমন্ত্রী। “আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আমরা গ্রামবাসীদের পক্ষে। গ্রামবাসীরা আমাদের পছন্দের লোক। তাঁরা অনভিপ্রেত কোনও ঘটনা ঘটাতে পারেন না। সরকার গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে।” বৈঠক শেষে বলেন পার্থবাবু। তাঁর আরও মন্তব্য, “যে জমিটিকে ঘিরে সমস্যা, সেটি অধিগ্রহণ হয়েছে সিপিএম আমলে। তাই সিপিএমের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। তবে গ্রামবাসীরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আস্থা জানিয়েছেন। গ্রামে অশান্তি যাতে না-ঘটে, সে বিষয়েও সহযোগিতারআশ্বাস দিয়েছেন।” পিডিএস নেতা সমীরবাবু বলেন, “আগের সরকারের সময়ে যখন জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, পদ্ধতিতে কিছু জটিলতা ছিল। আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইছি। ডিভিসি-এমটা, সরকার ও গ্রামের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গড়ার দাবি জানানো হয়েছে। সরকার বিষয়টি ভেবে দেখার আশ্বাস দিয়েছে।”
তবে ‘পুলিশ গুলি চালায়নি’ এবং ‘পুরো ঘটনার পিছনে মাওবাদী-সিপিএম-কংগ্রেস রয়েছে’ বলে মুখ্যমন্ত্রী-শিল্পমন্ত্রীর যে দাবি, তা এ দিন ফের খারিজ করেছে কৃষিজমি রক্ষা কমিটি। কমিটির সম্পাদক জয়দীপবাবুর কথায়, “এটা দশটা গ্রামের বাসিন্দাদের বাঁচার লড়াই। এতে মাওবাদী বা সিপিএম ছিল না।”
প্রসঙ্গত, দুবরাজপুর-কাণ্ডে পুলিশের খাতায় অভিযুক্ত জয়দীপবাবুকে যাতে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে আনা না-হয়, সে জন্য সরকারি তরফে কমিটির উপরে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। কমিটি অবশ্য এ দিন তাদের নেতাকে নিয়েই আসে। তার পরে আবার বিধানসভার ফটকে সমীরবাবুকে আটকানো হয়। সমীরবাবুর সঙ্গে কমিটির প্রতিনিধিরাও ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। শেষমেশ পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এসে পরিস্থিতি সামলান। তাঁর হস্তক্ষেপে সমীরবাবুরা বিধানসভার ভিতরে যান।
শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কমিটির প্রতিনিধিরা ‘পুলিশি গুলিচালনা’র বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে। শিল্পমন্ত্রী ওঁদের বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, প্রশাসনিক তদন্তে দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘পুলিশের’ গুলিতে আহতদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ ছাড়াও ওই দিনের ঘটনার আগে গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে যে সব মামলা রুজু হয়েছে, তা তুলে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে কমিটি। তাদের দাবি, শিল্পমন্ত্রী বিষয়টি ভেবে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে জয়দীপবাবু, ফেলারামবাবু ও আশিস মিশ্রের নামে পুলিশ যে মামলা দায়ের করেছে, তদন্ত-রিপোর্ট আসার পরেই তা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা হবে বলে শিল্পমন্ত্রী তাঁদের জানিয়েছেন।
পাশাপাশি কমিটির তরফে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দাবি পূরণের লক্ষ্যে কোনও পদক্ষেপ না-হওয়া পর্যন্ত লোবা গ্রামে ধর্না চলবে আগের মতোই। আজ, শনিবার লোবায় ফের একটি কেন্দ্রীয় সভার আয়োজন করেছে কমিটি, যেখানে আন্দোলনে যুক্ত সকলকে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। থাকার কথা সমীরবাবুরও। আন্দোলনকারীদের হাতে থাকা জেসিবি মেশিনটিকে নিয়ে অবশ্য চূড়ান্ত কোনও ফয়সালা হয়নি। মেশিনটি বাজেয়াপ্ত করতে সরকারকে আর্জি জানিয়েছে কমিটি।
বৈঠকের পরে দুবরাজপুরের তৃণমূল ব্লক সভাপতি ভোলানাথবাবু বলেন, “মন্ত্রী জানিয়েছেন, আলোচনাতেই যা হওয়ার হবে। আমরাও সমস্যার সমাধান চাই।” আর সমীরবাবুর কথায়, “গ্রামবাসীর স্বার্থ বিসর্জন না-দিয়ে উন্নয়নের পথে এগোনো আমাদের লক্ষ্য। আলোচনার পথেই সমাধান হতে পারে। সে দিকে একটু এগোনো গেল।” |
|
|
|
|
|