পাক্কা পাঁচশো গ্রামের মুড়ির প্যাকেটটা এনামেলের বাটির উপরে উপুড় করে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি। মুখোমুখি বসা সহোদর চিত্রবৎ চুপ।
--“ও মা... মা।”
পা ছড়িয়ে বসে থাকা দু-ভাইয়ের সামনে স্তূপীকৃত মুড়ির পাহাড়ে অবহেলায় খানিক জল ঢেলে দিয়ে যান বাণীদেবী। পা দাপিয়ে উঠোন পেরিয়ে যেতে যেতে বিড় বিড় করেন, “পারি না বাবা, রাক্ষস!”
সে কটূক্তি বাতাসে হারায়। মুড়ির বাটিতে তখন বাস্তবিকই হারিয়ে গিয়েছে দুই ভাই।
দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের এক গণ্ডগ্রামে শুরু হয় রাম-লক্ষ্মণের দিন যাপন।
সাত সকালে কেজিখানেক মুড়ি। বেলায় প্রায় পৌনে দু’কিলো চালের ভাত। সিদ্ধ কলমি শাক না হয় নিছকই চুনো মাছ। রাতেও বদল হয় না পদ কিংবা পরিমাণের। কিন্তু তাতেও পেট ভরে না। খিদের জ্বালায় রাতে খুনখুন করে কাঁদে তারা।
জাইগানটিজম-এ আক্রান্ত বছর দশেকের, সত্তর এবং সাতষট্টি কেজি ওজনের রাম-লক্ষ্মণ তাদের ‘অযোধ্যা’ পঞ্চগ্রামে সাক্ষাৎ ‘রাক্ষস’! হ্যাঁ, গ্রামের আদিবাসী পাড়া, রোগাক্রান্ত বালক দু’টিকে এ নামেই চেনে।
শুনে মনখারাপ হয় সোমরা তিরকের। তিনি বলেন, “নিজেরই তো ছেলে, লোকে রাক্ষস-খোক্কস বললে খারাপ লাগবে না! কিন্তু কী করব বলুন, রোজ দু’বেলা চার কিলো চাল আর এক কেজি মুড়ির জোগান দেওয়া সম্ভব, রাক্ষসই তো!” চোখ ছল ছল করে দিনমজুর বাবার। দিন খেটে সাকুল্যে ষাট-সত্তর টাকা রোজগারে কী এ খিদে ‘সামাল’ দেওয়া যায়? |
ছেলে বেলা থেকেই বড্ড ‘খিদে’ দুই ভাইয়ের। বাণীদেবী বলেন, “ভেবেছিলাম, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হল ঠিক উল্টোটা। এই টানাটানির সংসারে পাড়া-প্রতিবেশী অনেক সময়ে চালটা-কলাটা সাহায্য করেন। তাতে কোনও মতে ওদের দু’টো ফুটিয়ে দিই। কিন্তু আর পারছি না জানেন!” গ্রামেরই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে দুই ভাই। তবে অতিকায় চেহারা নিয়ে এখন বয়সোচিত হুটোপুটি নেই তাদের। দু-জনেই বলে, “খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু ছুটলেই হাঁফ ধরে।”
মাস কয়েক আগে গঙ্গারামপুর মহকুমা হাসপাতালে দুই ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মা-বাবা। চিকিৎসকেরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “বিরল রোগ। এই হাসপাতালে চিকিৎসা হবে না।” অভাবের সংসারে বাইরে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য কোথায় আদিবাসী পরিবারটির। পঞ্চায়েতের কাছে হত্যে দিয়েছিলেন তাঁরা। সাড়া মেলেনি। স্থানীয় উদয় পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান বিজেপির নিখিল বর্মন বলেন, “যতটুকু পারেন গ্রামের মানুষই সাহায্য করেন ওঁদের। দেখি, পঞ্চায়েত থেকে ওঁদের জন্য কিছু করা যায় কিনা।” এ যাবৎ সে দেখা আর হয়নি!
বছর কয়েক আগে মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বৃহৎ-শিশু লোকমান এমনই অনন্ত খিদে নিয়ে বেড়ে উঠছিল। অকালেই ঝড়ে গিয়েছিল সে। কিছু দিন আগে দক্ষিণ দিনাজপুরেরই বংশীহারির ফুট আটেক উচ্চতার তরুণী সিদ্দিকাও এই একই রোগের শিকার। খিদে অস্বাভাবিক সে তরুণীরও। দিশেহারা হতদরিদ্র বাবা-মা সিদিক্কাকে নিয়ে ছুটে ছিলেন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। কিন্তু ‘যথাযথ চিকিৎসা’ হচ্ছে না বলে শেষমেশ সেখান থেকে ফিরেই আসেন তাঁরা। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, হরমোনের সমস্যা।
পরিচিত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট নীলাঞ্জন সেনগুপ্ত রাম-লক্ষ্মণের কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, “খিদে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস এলাকা থেকে। সেখানে জন্মগত কোনও সমস্যা থাকলে বা টিউমার হলে এমন খিদে এবং সেই সঙ্গে ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
আর রাম-লক্ষ্মণ? পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটার ফাঁকে বলে, “খুব খিদে পায় কাকু জানো, ওইটুকু ভাতে আমাদের হয়?” |